চলমান বিদ্যুৎ সংকট কি বৃহত্তর সংকট ডেকে আনবে?

বাংলাদেশে বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যে সংকট শুরু হয়েছে, তা হওয়ারই কথা। তবে হতে যেমন সময় লাগেনি, সমাধানেও সময় লাগবে না এমন কিন্তু নয়।

মুক্তবাজার অর্থনীতির কচ্ছপ দৌড়ে নাম লিখিয়ে এখন সেটা ম্যারাথন দৌড় হয়ে উঠেছে। যে পিডিবি আগে শতভাগ উৎপাদন করত, তারা এখন মাত্র ৪৮ ভাগের জোগান দিতে পারে। ৫২ ভাগ বিদ্যুৎ বেসরকারি মাধ্যম থেকে আসে সেখানেই সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয় ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বছরের অধিকাংশ সময় অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা বিপিডিবিকে; যা আগের বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘বসে বসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে, যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতে হচ্ছে।’ এটা বোঝার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে আগেই সরকারকে সাবধান করা হয়েছিল, কিন্তু টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী-আমলাদের কথাকেই সরকার আমলে নিয়েছে।

৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন-ক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। তাদের পরে পর্যায়ক্রমে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি। এভাবে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকার ব্যয় করেছে ৯০০০ কোটি টাকা! সরকার পরিশোধযোগ্য শর্তে ভর্তুকি হিসেবে ১১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৮.৩ শতাংশ বেশি। পরপর দুই বছর বার্ষিক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান বিপিডিবির জন্য একটি ‘অশনি সংকেত’। এই সংকেত কেন আগে বোঝেনি সে প্রশ্নের উত্তর নেই।

গোটা বিশ্বেই বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ আনতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে গোটা বিদ্যুৎ খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়েছে। বিদ্যুৎ বেসরকারি খাতে ছাড়ার বেলায় উভয়ই আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন মেনে চলেছে। দেশে এখন দৈনিক ২ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস দেশীয় খনি থেকে আসছে। তার মধ্যে সব থেকে বেশি আসছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন থেকে। শেভরন ও তাল্লো মিলিয়ে দৈনিক ১ কোটি ৪৬ লাখ ঘনফুটের মতো গ্যাস দিচ্ছে, এবং মোট দেশীয় গ্যাসের ৩১ দশমিক ৪৪ শতাংশ আসছে ৭৫ সালের ৯ আগস্ট জাতীয়করণ করা পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে। যদি দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত করা যেত তাহলে দেশের মানুষকে কম টাকায় গ্যাস দেওয়া যেত। সেটা হয়নি। এখন বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে যত পরিকল্পনা করেছে সরকার, তার যদি ১০ ভাগও গ্যাস তুলতে পারত তাহলে আজকের এই সংকটে বাংলাদেশ পড়ত না। কিন্তু সেসব হয়নি। আর সে কারণে বর্তমানের এই গ্যাস সংকট থেকে সরকার তথা দেশের মুক্তিও নেই।

আজকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দোহাই দিয়ে এলএনজির ক্রয়মূল্য বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। এটা কি কেবল বাংলাদেশে? সারা বিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতি চলছে। জার্মানির মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও বাধ্য হয়েছে এনার্জি রেশনিং করতে। ‘নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করেছি’ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার পর পরই আইএমএফ থেকে লোন নিয়ে এলএনজি আমদানির বিল মেটাতে হচ্ছে।

এখন এই যে লিস্ট করে ব্যয় কমানোর কথা বলা হচ্ছে সেটাইবা মনিটর করবে কীভাবে? ১০-১৫ বছর আগে থেকেই প্রাইভেটকারে এলএনজি/এলপিজি দেওয়া বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে। উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে কম দামে গাড়ি হাঁকানোর বিলাসিতা কেন? সে সময় যদি গাড়িতে এলএনজি/সিএনজি বন্ধ করা হতো তাহলে একটা বাড়িতে তিন-চারটা গাড়ির বিলাসিতা বন্ধ হতো। যারা ৪০/৫০ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে পারেন, তারা ৯৪ টাকা দরে অকটেনও কিনতে পারে। কে শোনে কার কথা! দেশের প্রায় ৬০ ভাগ যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তর হয়েছে। ডিজেলের দাম বাড়লেও তারা ভাড়া বাড়ায়, সিএনজির দাম বাড়লেও ভাড়া বাড়ায়। ডিজেল, সিএনজি, এলএনজি সমান তালে খরচ হচ্ছে।

বর্তমান ফরেন রিজার্ভ, গ্যাসের সংকট, সে কারণে বিদ্যুতের সংকট একবার যখন শুরু হয়েছে তখন এর ব্যাকফায়ারে শিল্প, কল-কারখানা সবখানেই ইফেক্ট হবে। গার্মেন্টের প্রধান ক্রেতা ইউরোপের অবস্থা ভালো না। তার উপর প্রডাকশন কমে গেলে বা ব্যয়বহুল হয়ে গেলে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ফলে চতুর্দিক থেকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

দেশের বিদ্যুৎ খাতে মোট দায়-দেনার বড় অংশই তৈরি হয়েছে বিদেশি ঋণে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে। এ খাতে রাষ্ট্রীয় মোট দায়-দেনার পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি বকেয়া পরিশোধ বাকি রয়েছে ৭৮ হাজার ৯১ কোটি টাকা। ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকার দায় তৈরি হয়েছে বিদেশি ঋণে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সরকারের কাছে বিপিডিবির বকেয়ার পরিমাণ ৫৯ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সরকারকে দায়গ্রস্ত করে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতে দক্ষতার অভাবকে বড় একটি অনুঘটক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকারের কাছে ভর্তুকি ও ঋণ বাবদ খাতসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর দেনার পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। গত বছরের জুন পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের ১১ কোম্পানির ডিএসএল বকেয়ার পরিমাণ ৭৮ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিপিডিবির। বিশেষ করে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার চার্জ ও জ্বালানি খরচ পরিশোধ গিয়ে আর্থিক চাপে পড়েছে সংস্থাটি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার ভিত্তিতে। মোট ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এ প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ১৫ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। যদিও এখনই পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

স্থানীয় ও বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ খাত পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারি কোম্পানিগুলোর দায়-দেনাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে খাতটিতে মোট দায়-দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এত সব ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন যতই ৮১টি অগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত করুন না কেন তাতে তেমন একটা সুফল আসবে না। তারপরও “বাংলাদেশ কোনোভাবেও ‘শ্রীলংকা’ হবে না”, কারণ বিদেশি রেমিট্যান্স আছে। সেটাও যে মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে, সে আশঙ্কা কারও মাথাতেই আসছে না।

এখন কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য যে ৮টি ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার ঘোষণা এসেছে সেখানে ইতোমধ্যেই মসজিদ/মন্দিরে এসি ব্যবহার সীমিত রাখার নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান হয়েছে। বাকি রইল ৭টি নিষেধাজ্ঞা। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ, সপ্তাহে ১ দিন পেট্রল পাম্প বন্ধ, রাত ৮টার পর শপিংমল বন্ধ, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, সরকারি-বেসরকারি অফিসে ভার্চুয়াল মিটিং, অফিসের সময়সূচি ১-২ ঘণ্টা কমানো- এসব করে কত ইউনিট বিদ্যুৎ বাঁচাবেন? শেষ পর্যন্ত শহরের সবই চলবে, দেখা যাবে ধান ক্ষেতে পানি দেওয়ার পাম্পে বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না। তখন কী হবে?

সরকারি নির্দেশের পরও কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে তারা ঠিকই নানান প্রজেক্ট নিয়ে বিদেশে ভ্রমণ চালু রেখেছেন। এসব কৃচ্ছসাধনও তদারকির অভাবে ব্যর্থ হওয়ার পথে। সচিব-আমলা-মন্ত্রীদের সকল গাড়ি সিজ করে পুলের বাসে যাতায়াত করতে বাধ্য করা, দেশের সকল ফুয়েল পাম্পের আলোকসজ্জা বন্ধ, সপ্তাহের ৩ দিন প্রাইভেটকারমুক্ত দিন ঘোষণা করা উচিত। এগুলো কি সম্ভব? সচিবালয় থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা সরকারি অফিসে লাট সাহেবী কায়দায় এসি চলে। আমলা-সচিবরা ২০০০ সিসির নিচে গাড়ি চড়েন না! ওই সব দামি গাড়ি লিটারে মাত্র ২-৩ কিলো চলে। তার মেইটেনেন্স খরচ বিমান পোষার মতো। এ সকল কৃচ্ছতা সাধন আন্তরিকভাবে না করলে বিদ্যুৎ আরও বড় সংকট ডেকে আনতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //