রেলওয়েতে কালোবেড়ালের ছায়া

অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে ট্রেনের টিকিটপ্রাপ্তিতে জটিলতা, কালোবাজারি, নানামুখী যাত্রী হয়রানি হয়ে আসছে। টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনা এখানে নিয়মিত। এসব কাজে রেলওয়েরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে মুখ খোলেন না কেউ।

সম্প্রতি দীর্ঘদিনের এসব অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। তার নাম মহিউদ্দিন রনি। রনির প্রতিবাদ নাড়া দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও। রেলের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পাশাপাশি ছাদে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এদিকে কর্তৃপক্ষের আশ্বাস না পাওয়ায় আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন মহিউদ্দিন রনি।

কী ঘটেছিল রনির সঙ্গে? জানা যায়, রেলওয়ের ওয়েবসাইট থেকে গত ১৩ জুন ঢাকা-রাজশাহী রুটের ট্রেনের টিকিট কেনার চেষ্টা করেন তিনি। রনির বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু ট্রেনের কোনো আসন রনি পাননি। পরে কমলাপুর রেলস্টেশনে সার্ভার কক্ষে অভিযোগ জানান তিনি। কিন্তু সেখান থেকে তাকে ‘সিস্টেম ফল’ করার কথা বলা হয়। আরও বলা হয়, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে টাকা না পেলে আবার যেতে। ঠিক সেই মুহূর্তে ওই কক্ষে থাকা কম্পিউটার অপারেটর ৬৮০ টাকার আসন ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছিলেন তা দেখে ফেলেন রনি। আর এ অব্যবস্থাপনা নিয়ে ১৪ ও ১৫ জুন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে কোনো জবাব বা শুনানির জন্য ডাক আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে গত ৭ জুলাই থেকে মহিউদ্দিন রনি কমলাপুর রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে অবস্থান ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করেন। পরে পুলিশ বাধা দিলে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী তার সঙ্গে কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে রনির দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। রনির এই প্রতিবাদ আসলে এ দেশের সাধারণ জনতার। রেলের বিরুদ্ধে কেউ মুখ না খুললেও এর হয়রানির শিকার হয়েছেন সকলে। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার এত বছর পর দেশে অনেক খাতের উন্নয়ন ঘটলেও রেল এখনো জরাজীর্ণ। সূত্র বলছে, রেলে ১ টাকা আয় করতে ব্যয় হয় ৬ টাকা! ২০২০-২১ অর্থবছরে রেল আয় করেছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময় রেলে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এমন লোকসান প্রতিবছরই করছে রেল! কিন্তু কেন? এক কথায় এর উত্তর, অনিয়ম ও দুর্নীতি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী রেলে নিয়োগ, কেনাকাটা, টিকিট বিক্রি ও ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতিসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের ১০ খাতে অনিয়ম হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রেলওয়ের অধীনে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়। রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ ক্রয় ও সংগ্রহ ছাড়াও বিভিন্ন সেকশনের স্টেশন সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকায়নে দুর্নীতি হয়। তাছাড়া ডাবল লাইন, সিঙ্গল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ কাজে ও রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতি হয়ে থাকে। এছাড়া রেলওয়ের অধীনে ওয়ার্কশপগুলোও স্লিপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অনিয়ম, রেলওয়ের টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে কালোবাজারি হয়ে থাকে এবং এ কালোবাজারিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মচারীরা অনিয়ম করে থাকেন। 

দুদকের প্রতিবেদন বলছে, কতিপয় দালাল বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মচারীদের সহযোগিতায় আন্তঃনগর ট্রেনের অধিকসংখ্যক টিকিট ক্রয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এর ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে।

জানা যায়, প্রতিদিন ৩৯৪টি ট্রেন পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সমস্যা হলো, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি পরিচালনায় ব্যয় হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রেলওয়ে। গত ৫ বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে ২০১৯-২০ অর্থবছর। লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর রেলওয়ে সব মিলিয়ে ৬৩৭ কোটি যাত্রী পরিবহন করে। একইভাবে ৩১ লাখ ৭৭ হাজার টন পণ্য পরিবহন করে। যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনায় খরচ হয় ৩ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। বিপরীতে সংস্থাটি আয় করে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। ধারাবাহিক এমন বড় অঙ্কের লোকসানের জন্য রেলের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রেল খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ, রেলের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত এবং যাত্রীসেবার মান না বাড়ানো হলে লোকসান কমানো কষ্টকর হবে। রেল পরিসেবার মানোন্নয়ন ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। লোকসান কাটিয়ে লাভে ফিরতে রেলওয়েকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো যাত্রীসেবা, অনবোর্ড সেবা, ক্যাটারিং সেবার মান বৃদ্ধিসহ যাত্রীদের টিকিটপ্রাপ্তি নিশ্চিত, পণ্যবাহী ও কনটেইনার ট্রেন পরিচালনায় গুরুত্ব দেওয়া, কমিউটার ট্রেনকে আরও জনবান্ধব করে তোলা এবং বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার করে বাণিজ্যিক ব্যবহার করা।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে বলা যায়, রেলের ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রকল্প সমাপ্ত হতে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে তিনগুণের বেশি। তবে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন শুনিয়েছেন আশার বাণী। তিনি মনে করছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে অবকাঠামো। সেই সঙ্গে লাভজনক হয়ে উঠবে সংস্থাটি। তিনি বলেন, নতুন নতুন রেলপথ, রেলসেতু নির্মাণ, বন্ধ থাকা স্টেশন চালু ও নতুন কোচ-ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎচালিত, হাইস্পিড ট্রেন চালুর জন্য কাজ করছি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় রেলপথ নির্মাণ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, বাংলাদেশও সেগুলোর ব্যবহার শুরুর পরিকল্পনা হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামোর মান আরও উন্নত হবে এবং রেল লাভজনক অবস্থায় চলে আসবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন রেলের এই অবস্থা দূর করতে কিছু সুপারিশ করেছে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও বিভিন্ন ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত বা ই-টেন্ডারিং দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানসম্পন্নদের অন্তর্ভুক্ত করতে। তাছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার, বাসভবন বা অফিস স্থাপনার সম্পত্তিসমূহ ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রির মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুতসহ অবৈধভাবে দখল করা সম্পত্তি নিজ তত্ত্বাবধানে আনা ও রেলওয়ের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য ডাটাবেজ তৈরি করতে বলেছে দুদক।

পাশাপাশি রেলওয়ের ওয়ার্কশপ ও স্লিপার ফ্যাক্টরিগুলো সচল এবং সেগুলো তদারকির জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে। তাছাড়া একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পিপিএ এবং পিপিআর অনুসরণ, অডিট কার্যক্রম জোরদার, টিকিট কালোবাজারি রোধে বিক্রয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার ও নিয়মিত মনিটরিং, রেলওয়ের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠাকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা ও রেলওয়ের সকল কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে দুদক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //