ব্যর্থ ঢাকা ওয়াসা

বাড়ছে পানির দাম

কিছুদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির তীব্র সংকট। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না থাকায় রাজধানীবাসীকে সেবা দিতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা। এলাকায় এলাকায় কেবল হাহাকার। কোথাও দিনে কেবল দু-একবার পানি আসে, তাও দুর্গন্ধের জন্য মুখে নেওয়া যায় না।

অথচ এ সংকটের মধ্যেই উল্টো পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে আবাসিক গ্রাহককে প্রতি হাজার লিটার পানি ব্যবহারের জন্য দিতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য ৪২ টাকা। সেপ্টেম্বর থেকে এর সঙ্গে পাঁচ শতাংশ অতিরিক্ত যুক্ত হবে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এতটুকুতেই সন্তুষ্ট নয়, তারা আরও দাম বাড়াতে চায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কুড়িল, বিশ্বরোড, বসুন্ধরা, কালাচাঁদপুর, খিলবাড়ীরটেক, নূরেরচালা, শাহজাদপুর, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, মেরুল ডিআইটি, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, মাতুয়াইল, জুরাইন, মিরপুর, রূপনগর, আগারগাঁও, রায়েরবাজার এলাকায় পানির সংকট সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে খিলবাড়ীরটেকের বাসিন্দারা এক মাস ধরে পানির সংকটে রয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মিলছে না সেই সোনার হরিণ। গোসল করা তো দূরে কথা রান্না ও খাওয়ার জন্য বালতি নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরেও পানি পাচ্ছে না মানুষ। 

স্থানীয়রা জানান, ওয়াসার জোনাল অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানালেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। উপায় না পেয়ে ওয়াসার কাছ থেকেই গাড়িতে করে পানি কিনে আনতে হচ্ছে। তাতেও রয়েছে নানা অনিয়ম।

বাড়িতে পানি নেই, পাইপে ছিদ্র, নোংরা পানি আসছে, দুর্গন্ধ, ঠিকমতো বিল আসছে না, কখনো কখনো বেশি আসছে, মিটারের তথ্য ভুল- ঢাকা শহরে কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই এমন সমস্যার কথা শোনা যায়। এ বিষয়গুলো স্পষ্টভাবেই উঠে আসে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে। তারা ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওয়াসার সেবা এলাকার তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাটির সেবার মান ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সার্বিকভাবে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতাই অসন্তুষ্ট। আর ঢাকা ওয়াসার গ্রাহকদের ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ বলছেন- পানি অপরিষ্কার, ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ গ্রাহক পানিতে দুর্গন্ধ থাকার কথা জানান। ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ গ্রাহকের দাবি, সারা বছরই পানি অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধযুক্ত থাকে। এ ছাড়া সার্বিকভাবে সেবাগ্রহীতাদের ৪৪ দশমিক ৮ ভাগ পানিই পান না। ব্র্যাকের গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ৩৭ শতাংশ ঢাকাবাসী ঠিকমতো পানি পেয়ে থাকেন। তার মানে ৬৩ শতাংশ মানুষকেই পানি নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। চার বছরে এ সংকট আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। 

পানির সংকট দেখা দিলে ওয়াসার অসাধুদের যেন পোয়াবারো। কেননা তখন ধরনা দিতে হয় ওয়াসার পানি বিক্রেতাদের কাছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওয়াসা তাদের গ্রাহকদের জিম্মি করে পানির ব্যবসা করছে। ছোট এক গাড়ি পানির মূল্য যেখানে ৪০০ টাকা রাখার কথা সেখানে কাগজেকলমেই নেওয়া হয় এক হাজার টাকা। বড় গাড়ির সরকারি মূল্য ৬০০ হলেও দিতে হয় ১২০০ টাকা। এ ছাড়া আরও কয়েকশ আবার বকশিস দিতে হয় গাড়িচালককে। কিন্তু যারা গাড়ি থেকে পানি নিতে পারছেন না তারা অন্য উপায়ে কিনে খাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জার পানির ব্যবসায়ীদের ৪০ টাকার পানি তখন হয়ে যায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এর সঙ্গেও ওয়াসার দুর্নীতিবাজরা জড়িত। কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জারের পানি ওয়াসার পাম্প থেকেই সরাসরি ভর্তি করা হয়। 

খিলবাড়ীরটেকের বাসিন্দা তানভীর হাসান বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পানির সমস্যা লেগেই থাকে; কখনো খোঁড়াখুঁড়ি, কখনো লাইন মেরামতের অজুহাতে। কখনো আবার বলা হয়- লাইনে পানি নেই, সময় লাগবে। তবে আমার কাছে মনে হয়, অবৈধ আয়ের সুযোগ নিতে এটি ওয়াসার লোকদের তৈরি করা কৃত্রিম সংকট। বিভিন্ন এলাকায় এটা করা হয় আবার পালাক্রমে।’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো পানিসংকট সৃষ্টি হলে ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তাদের দালালরা এসে জানায়, ভূগর্ভস্থ লাইন ঠিক করলেই পানি আসবে। এক্ষেত্রে তারা কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করে বসে। উপায় না দেখে তখন এলাকাবাসী চাঁদা তুলে ওই টাকা তাদের হাতে তুলে দেন। অবৈধ এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কিছু লোকজনও জড়িত। তারাও এ টাকার ভাগ পান।’

অনিয়মের বিষয়টি টিআইবির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়- গ্রাহকদের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশই অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার। পানি সংযোগের জন্য ২০০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। পাশাপাশি পয়ঃলাইনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ৩০০ থেকে সাড়ে ৪ হাজার, গাড়িতে করে জরুরি পানি সরবরাহের জন্য ২০০ থেকে দেড় হাজার, মিটার কেনা বা পরিবর্তনের জন্য এক থেকে ১৫ হাজার, মিটার রিডিং ও বিল সংক্রান্ত কাজের জন্য ৫০ থেকে ৩ হাজার এবং গভীর নলকূপ স্থাপনে ‘বকশিশ’ দিতে হয় এক থেকে দুই লাখ টাকা।

দীর্ঘদিন ধরেই পানির সমস্যা রাজধানীর মিরপুরে। নানা অভিযোগ-অনুযোগেও কান দিচ্ছে না ওয়াসার লোকজন। নিরুপায় হয়ে স্থানীয় মসজিদ কিংবা ব্যক্তিগত পাম্প থেকে লাইন ধরে পানি নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটান স্থানীয়রা। আশরাফুল ইসলাম নামে একজন বলেন, ‘আমার মেয়ের স্কুল এই এলাকায় হওয়ায় এতদিন পানির কষ্ট করেছি। এখন দেখছি ঠিকমতো গোসল ও খাওয়াদাওয়া করতে না পারায় ওরা প্রায় সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কয়েক দিন পরপরই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয়। প্রতিমাসেই বাড়িওয়ালা বিল নেয় ঠিকই, কিন্তু পানি নেই।’ 

মিরপুরের একটি বাড়ির মালিক মশিউর রহমান বলেন, ‘পানির তীব্র সমস্যা থাকায় ভালো ভাড়াটিয়া পাওয়া যায় না। তা ছাড়া ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে চলে যেতে পারলেও, আমরা কই যাব কন?’ 

ওয়াসা অবশ্য বলছে, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ঢাকায় ৮০০টির বেশি পাম্পের মধ্যে ১০০টির বেশি পাম্পে গভীর পাইপ (বোরিং) বসানো হচ্ছে। সেই কাজ শেষ হলে পানি সমস্যার সমাধান হবে অনেকটাই। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গন্ধবপুর পানি শোধনাগার চালু হলে ভূগর্ভের পানির উপর নির্ভরতাও কমে আসবে অনেকাংশে।

এদিকে রাজধানীবাসীর এসব সংকটের সমাধান না করেই আবাসিকে ২৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত পানির দাম বাড়াতে চায় ওয়াসা। এ জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তাতে বলা হয়েছে, পরিচালনা ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকার (ডিএসএল) পরিমাণ অনেক বেড়েছে। বর্তমান পানির দামে ওয়াসার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডিএসএল পরিশোধ করা বেশ কঠিন। ঋণের টাকা পরিশোধ এবং ব্যয়ভার বহন করতে পানির বিশেষ মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে ধনী-গরিব এলাকা ভাগ করে কোথাও বেশি আবার কোথাও কম দাম নির্ধারণ করতে চায় তারা। বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের জন্য লো ইনকাম কমিউনিটি (এলআইসি) পানির দাম অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এলাকাভিত্তিক আলাদাভাবে দাম বাড়াতে ওয়াসার হয়ে এরই মধ্যে গবেষণা চালিয়েছে ওয়াটার এইড। 

আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। তার বেশি বাড়াতে চাইলে দ্বারস্থ হতে হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। সে অনুযায়ী, সবশেষ গত ৬ জুলাই ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সভায় পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমান মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনায় রেখে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু উৎপাদন ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর তাগিদ দেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।

এ বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পানির দাম বাড়ালে জনগণের উপর চাপ বাড়বে। তাই ওয়াসা বোর্ড চাইছে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর। আবার বিপুল ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আরও নানা ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে এমডি তাকসিম এ খান পানির দাম আরও বেশি বাড়াতে সরকারের কাছে গেছেন।’ 

বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকটের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তার মধ্যে এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। পাশাপাশি অনেকগুলো পাম্পই বিকল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে কিছু কিছু এলাকায় এই পানির সংকট। তবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের ৮০০টিরও বেশি পাম্প রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ১০০টিরও বেশি পাম্পে বোরিংয়ের কাজ চলছে। সেগুলো হয়ে গেলে আশা করা যায় নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে পানির সংকট সমাধান হয়ে যাবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার দৈনিক পানির চাহিদা ২৬৫ কোটি লিটার। এর ৬৪ শতাংশ আসে ভূগর্ভের পানি থেকে। কিন্তু পানির স্তর বেশ নিচে চলে যাওয়ায় প্রায় হাজার ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে। আমরা বেশকিছু নতুন পাম্প বসাতে চাচ্ছি। এর জন্য অবশ্য জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে গন্ধবপুর পানি শোধনাগার চালু হলে ভূগর্ভের পানির উপর নির্ভরতা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে আসবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //