অতি মুনাফার লোভেই গার্ডার দুর্ঘটনা

সরকারি কোনো প্রকল্পের নির্মাণকাজে নিরাপত্তার বিষয়টি একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কারণ অঘটন ঘটলেও কারও জবাবদিহি নেই। অবহেলার দায়ে শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় পার পাওয়া যায় সহজেই। তাই উন্নয়ন কাজে বারবারই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা, প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। সর্বশেষ রাজধানীর উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের বক্স গার্ডার প্রাইভেটকারের উপর পড়ে দুই শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন। 

আগেও একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় গত বছরের ১৪ মার্চ বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার লঞ্চার ভেঙে তিন চীনা কর্মীসহ ছয়জন আহত হন। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফাইওভারের লঞ্চিং গার্ডার চাপায় প্রকল্পটির এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন আরও এক শ্রমিক ও একজন পথচারী। ২০১৭ সালের ১২ মার্চ রাতে ঢাকার মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ৩৬ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ভেঙে পড়ে। রেললাইনের উপরের ওই ঘটনায় একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। পা হারান আরও দুজন।

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়েছিল দুই দফায়। প্রথমবার ২০১২ সালের ২৯ জুন কংক্রিটের ১৩০ ফুট দীর্ঘ গার্ডার ভেঙে পড়ে একজন রিকশাচালক আহত হয়েছিলেন। এরপর একই বছরের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারটির তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন আরও অনেকে। তখন অভিযোগ ওঠে, কয়েক মাস আগে ছোট দুর্ঘটনাটি ঘটার পরও যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়নি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমস। পরে ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ও নির্মাণকাজে জড়িত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তবে সেই মামলার বিচার আজও শেষ হয়নি। এছাড়াও গত ৭ জুন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি সেতুর গার্ডার ধসে লিয়াকত হোসেন নামে এক শ্রমিক নিহত হন। ২৮ এপ্রিল রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কে একটি নির্মাণাধীন সেতুর গার্ডার ধসে একজন শ্রমিক নিহত এবং আহত হয় আরও ১৫ জন। 

একইভাবে বারবার কেন দুর্ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুস সবুর বলেন, ‘অবহেলাটা এখানে স্পষ্ট। একটি প্রতিষ্ঠান যখন কাজ করে তখন নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা থাকে। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না বলেই দুর্ঘটনা ঘটে বারবার।’ 

ক্রেন দিয়ে ভারী বস্তু তোলার সময় কিংবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানোর সময় যে দুর্ঘটনা ঘটে না তা নয়। বিশ্বের উন্নত প্রায় সব দেশেই কখনো না কখনো ক্রেন-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটছে। এমনকি প্রাণহানিও হয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে ক্রেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদর্শ নিয়ম মেনে যত ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেগুলো নেওয়া হয়। আর উত্তরায় যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে ভারী বস্তু তোলাসহ ক্রেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদর্শ নিয়ম মানা তো দূরের কথা, ন্যূনতম নিয়মও মানা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত এ ধরনের কাজ চলাকালে কী কী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে লিখিতভাবে জানাতে হয়। তাদের সেই পদক্ষেপে পরামর্শক এবং প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলেই কেবল ঠিকাদাররা বিল পেয়ে থাকেন। অথচ বিআরটির প্রকল্পে এতদিন অরক্ষিত অবস্থায় কাজ চললেও বিল তোলা হয়েছে নিয়মিত।

বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম প্রকল্পটির সার্বিক দায়িত্বে থাকলেও তিনি অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার দায় চাপিয়েছেন প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের ঘাড়ে। চীনের অনাপত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত ক্রেনের চালক, তার সহকারী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে র‌্যাব।

যোগাযোগবিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান নিরাপত্তা-বেষ্টনী ছাড়াও আরও তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন এ নির্মাণকাজ নিয়ে। তিনি বলেন, ক্রেন ঠিক আছে কিনা এবং ক্রেনটি যে অপারেট করছিলেন, তার লাইসেন্স আছে কিনা। তিনি অভিজ্ঞ কিনা- এটাও তদন্তের মাধ্যমে দেখতে হবে। আবার গার্ডারের যে ওজন ও ক্রেনের যে সক্ষমতা, সেটা ঠিক আছে কিনা- এই জিনিসটাও গুরুত্বপূর্ণ। 

এ বিষয়ে র‌্যাবের মাধ্যমে জানা যায়, প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছে দুর্ঘটনার দিন ওই ফিটনেসবিহীন ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন হেলপার, দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অপারেটর। অথচ ওই হেলপারের ক্রেন চালানোর কোনো ধরনের প্রশিক্ষণই ছিল না। আবার মূল অপারেটরেরও হালকা যান চালানোর লাইসেন্স থাকলেও ক্রেনের মতো বিশেষায়িত ভারী যানের লাইসেন্স ছিল না। এমনকি যে ক্রেনটি দিয়ে গার্ডার তোলা হচ্ছিল সেটার ধারণক্ষমতা ৮০ টন। আর গার্ডারটি ওজন ছিল ৭০ টন। রাস্তায় কাজ চলার কারণে ক্রেনের একদিক উঁচুতে ছিল, আরেকদিক ছিল নিচুতে। ফলে এটা উল্টে যায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় দুর্ঘটনাকবলিত গার্ডারটি ওই ক্রেন দিয়েই সরানো হয়েছে।

র‌্যাব আরও জানায়, প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন জুলফিকার আলী শাহ। বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর পর্যন্ত নির্মাণকাজে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিল তার। অথচ এত বড় প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার মতো কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ তার নেই। তিনি কেবল এসএসসি পাস। অনভিজ্ঞ জুলফিকার তাই দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনীই বসাননি। ব্যস্ত এই সড়কে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত লোকও নিয়োগ করেননি।

পাঁচ বছরের এ প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় তা চরম গণভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। প্রকল্পের আকার এখন ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও র‌্যাবের তথ্য বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়েই খরচ কমানোর চেষ্টা করে গেছে। দুর্ঘটনাস্থলে যে ক্রেনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেটির বয়স অন্তত ২৬ বছর। মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রটি দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ টন ওজন তোলা যায়। আর ওই ক্রেনটি দিয়ে যখন সোজাসুজিভাবে না তুলে আড়াআড়িভাবে তোলা হয়, তখন সেটির ভার বহন সক্ষমতা আরও কমে যায়। ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড ‘খরচ কমানোর জন্য’ অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়েই সেটি পরিচালনা করছিল বলে র‌্যাবের ভাষ্য। এমনকি ভাড়ায় নেওয়া ক্রেনটির সক্ষমতা যাচাইয়ের কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘যে কোনো প্রকল্পে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ থাকে। অথচ বিআরটির প্রকল্পে ন্যূনতম কোনো স্ট্যান্ডার্ড মানা হয়েছে কিনা সন্দেহ। কেননা কোনো ভারী নির্মাণসামগ্রী যখন নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন আসে, সেখানে অবশ্যই কোনো না কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থা থাকতে হয়। ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে যেতেই পারে, এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেন না ঘটে, তার জন্যই নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা জরুরি। উত্তরায় সেই নজরদারির যথেষ্ট অবহেলা ছিল বলেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।’

আইন কী বলে

কাজের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ব্যাপারে বাংলাদেশের পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৮০ ধারায় বলা হয়েছে- ‘দুর্ঘটনা অথবা দুর্ভাগ্যবশত এবং কোনো প্রকার অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বা অবগতি ব্যতিরেকে আইনানুগ প্রণালিতে আইনগত মাধ্যমের সাহায্যে এবং যথাযথ যত্ন ও সতর্কতার সঙ্গে সম্পাদিত কোনো আইনানুগ কাজ অপরাধ নয়।’ এ আইনে দণ্ডবিধির ৩০০ ধারায় কোনো ধরনের প্রাণহানি হত্যাকাণ্ডের পর্যায়ে পড়বে তা নিয়ে চারটি ভাগে লেখা হয়েছে; সেখানে চতুর্থ ভাগে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি কাজটি করে যদি সেই ব্যক্তি জানে যে, কাজটি এমন বিপজ্জনক যে তার ফলে খুব সম্ভব মৃত্যু ঘটবে কিংবা মৃত্যু ঘটতে পারে এবং তিনি যদি সেই কাজটি করেন।’ কিন্তু উত্তরায় যে নির্মাণকাজ চলছে তা যথাযথ যত্ন ও সতর্কতার সঙ্গে হচ্ছে কিনা, বারবার দুর্ঘটনা ঘটার পর তা নিয়ে আর প্রশ্ন থাকারই কথা নয়। 

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, সেখানে গার্ডার তোলার জন্য সঠিক মানের ক্রেন ব্যবহার করা হয়নি। এ ধরনের একটি বিপজ্জনক কাজ করার ক্ষেত্রে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার যে নিয়ম সেটা মানা হয়নি কিংবা নিরাপদ দূরত্ব মেনে গাড়ি চালানোর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প চলবে দুর্বার গতিতে। তবে সেগুলোতে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। নির্মাণ প্রকল্প এলাকার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করেই কাজ চালাতে হবে। জনগণকে কীভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায়, সুবিধা দেওয়া যায় আগে সেটি ভাবতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনো প্রকল্পের কাজ করা যাবে না। আমি যে কোনো সময় বিভিন্ন সাইটে পরিদর্শনে যাব, সঙ্গে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা যাবেন। কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, যারা ভারী কাজ করবে, বিশেষ করে যারা ক্রেন চালাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। এমনকি ডোপ টেস্টও করাতে হবে। নো সেফটি, নো ওয়ার্ক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //