অনিয়ম-দুর্নীতির বেড়াজালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে বেশ কিছুদিন ধরেই। আর যারা এসবের কারিগর, তারা এতই ক্ষমতাবান যে, প্রমাণ মিললেও শাস্তি বড়জোর পরের বার পুনরায় নিয়োগ না পাওয়া। ফলে দিন দিন অনিয়ম-দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে কিছুদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের করা তদন্ত প্রতিবেদনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির বড় অংশজুড়ে উঠে এসেছে নিয়োগ বাণিজ্যের কথা। অর্ধশতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই আছে স্বজনপ্রীতি, ঘুষ এবং দলীয় পরিচয়ে নিয়োগের অভিযোগ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, গুরুত্বপূর্ণ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া আসলে কীভাবে সম্পন্ন হয়, আর কীভাবে হওয়ার কথা?

সূত্র বলছে, অর্গানোগ্রাম অনুসারে নির্ধারিত থাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংখ্যা। অবশ্যই এই অর্গানোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদনকৃত হয়। অনুমোদিত হওয়ার পর প্রতিটি অর্থবছরে নিয়োগের বিপরীতে বরাদ্দ থাকে অর্থ। অর্থ বরাদ্দপ্রাপ্তি সাপেক্ষে কোনো নির্দিষ্ট পদের বিপরীতে নিয়োগ দিতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়।

এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর সাধারণত ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ সময় দেয়া হয় যাতে প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেন। সেসব আবেদন পাওয়ার পর এগুলো যাচাইবাছাই করা হয়। প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হলে নেয়া হয় লিখিত পরীক্ষা। এরপর সেখান থেকে মেধাক্রম তালিকা করে নেয়া হয় মৌখিক পরীক্ষা এবং এরপর চূড়ান্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়। আবার কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কার্যক্রম থাকে। সেক্ষেত্রে কাউকে নিয়োগ দেয়ার আগে সেই বিভাগে লোকজন প্রয়োজন আছে কি-না, সেটা বিভাগের পরিকল্পনা কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত হতে হয়। আর কেবল এই সুপারিশ পাওয়ার পরই প্রকাশ করা যায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এরপর সিলেকশন বোর্ড সুপারিশ করে। এটা সিন্ডিকেটে অনুমোদন পাওয়ার পর যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ পেয়ে থাকেন।

বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্গানোগ্রাম মানলে সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন ভিসির কন্যা বা পুত্র কিংবা জামাতা কি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্য হতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। কিন্তু একই মেয়াদে যখন কেউ পরিবারের হাফ ডজন বা তারও বেশি লোক নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে ঢুকান, তখন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। সম্প্রতি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে। আর এ কারণেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় খুকৃবির উপাচার্যকে চিঠিতে তার নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে, ভাতিজাসহ নিজ পরিবারের ৯ জনের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, এর সাথে ৭৩ জনের নিয়োগও বাতিলের কথা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সেই চিঠিতে আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মো. মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশনাপত্র গত ৩ আগস্ট ২০২২ তারিখে ভিসি বরাবর প্রেরণ করা হয়। ইউজিসি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে এ নির্দেশনা দেয়া হয় বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর ভিসি হিসেবে শহীদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলেই শেষ মুহূর্তে তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ বিষয়ে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ডা. খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার গণমাধ্যমকে বলেছেন, গত ২৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি তারা হাতে পেয়েছেন। আর কী আছে সেই চিঠিতে?

জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ইউজিসির তদন্ত কমিটির নিকট ভিসি নিজেই স্বীকার করায় তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় ৯ জনের নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ, বিষয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া একই ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে সিলেকশন বোর্ড গঠন করে ২০টি বিষয়ে ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ, সরাসরি প্রফেসর পদে নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে ভিসির স্ত্রী আবেদন করেছেন সেটি বাতিল করার ব্যবস্থা করা, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ করে যুগোপযোগী করার ব্যবস্থা গ্রহণ, ভবিষ্যতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ, বিষয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া সিলেকশন বোর্ড গঠন না করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়- এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশসমূহ অনুসরণ করা।

ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই কাণ্ডের আরও আগেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগে অনিয়মের কিছু বিষয় ইউজিসির তদন্তে প্রমাণ হয়ে যায়। ইউজিসির করা তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তা আটকে যায়।

মোদ্দা কথা হলো, ভিসি নিজের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে ৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। ইউজিসির তদন্তে স্বজনপ্রীতি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণও উঠে এসেছে।

জানা যায়, অভিযুক্ত এই ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ২০২০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৫ জন সদস্য। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। এই তদন্ত কমিটি গত ২৩ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিসি নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক, ভাতিজা, শ্যালিকার ছেলে এবং আত্মীয় মিলে ৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন।

তাছাড়া শুধু মেয়েকে নয়, ভিসি নিজের স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। পরে এই নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ তদন্ত কমিটি বলছে, ভিসির স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেননি। খুকৃবির এই ঘটনার আগে স্বজনপ্রীতির আলোচিত ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে নিজের মেয়ে ও জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

এছাড়া তার প্রশাসন একইভাবে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এসব বিষয় একদফা তদন্ত করে ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করেছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভয়ানক ব্যাপার ঘটেছিল, তার মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে। সেদিন তিনি ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন!

বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে কী চলছে তা বোঝার জন্য উপরে উল্লেখিত দুটো ঘটনাই যথেষ্ট। বিগত কয়েক বছরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করেছে ইউজিসি, সেসব প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমাও পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে এমন নীরব কেন? নিয়োগ বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব কম থাকায় কিংবা প্রায় না থাকায় এসব কর্মকাণ্ড এখনো চলমান।

সূত্র বলছে, নিয়োগ কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত এক দশকে কেবল রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্যকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। আর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া উপাচার্যদের মেয়াদপূর্তি করতে দেয়ার অসংখ্য ঘটনা আছে। এত বড় অনিয়ম আর দুর্নীতির শাস্তি বলতে দ্বিতীয়বার আর নিয়োগ না দেয়া।

বাংলাদেশে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে যার সকল নিয়োগ অবৈধ। রাজধানী ঢাকার বছিলায় অবস্থিত ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগই অবৈধ বলে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ইউজিসি। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন কেউ কেউ। সেটি হতে আপত্তি থাকত না যদি অন্তত অনেক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নিয়োগ দেয়া না হতো।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বলছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সন্তানকে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। এ রকম ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে। সাবেক এক উপাচার্যের ছেলে প্রথমে সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। যোগ্যতা না থাকায় তা বাতিল হয়। কিন্তু বছর খানেক পর তাকে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এজন্য কয়েক দফায় নিয়োগবিধি সংশোধন করে যোগ্যতা শিথিল করতে হয়েছিল। শুধু কি তাই, বাউবিতে ৩৮ বছর বয়সী শ্যালিকাকেও বয়স ও শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ আছে।

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বা পিছিয়ে থাকার পরও মৌখিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিক বেশি নম্বর দিয়ে প্রথম করা, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ঘষামাজা এবং বিজ্ঞাপিত পদের দ্বিগুণের বেশি নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। আছে ঘুষ লেনদেন, অনুগত থাকা কাউকে নিয়োগ দান, রাজনৈতিক পরিচয়সহ আরও নানা অবৈধ বিষয়। এসব নিয়োগের তদন্ত করছে ইউজিসি। তারা প্রতিবেদনও পাঠাবে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নেয় তা-ই এখন দেখার বিষয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //