জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়

বিপর্যস্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখনো অচল

জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠলেও বিপর্যয়ের দিন বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক বিদ্যুকেন্দ্র এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফিরে যেতে পারেনি। কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাধিক ইউনিট এখনো বন্ধ রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব না হওয়ায় ঘোষিত শিডিউলের চেয়ে বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এতে লোডশেডিংয়ের ম্যাপেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সম্ভাব্য যে শিডিউল প্রকাশ করা হচ্ছে বাস্তবে ‘অপরিকল্পিত’ লোডশেডিং হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর গত চার দিন ধরে অপরিকল্পিত লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল শুক্রবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি এবং জেলাগুলোতে ১০ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে মানুষ। প্রতিবারই এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় করে লোডশেডিং হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। গ্রিডের সমস্যা কবল থেকে বেরিয়ে এলেও সব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো উৎপাদনে আসতে পারেনি। কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাধিক ইউনিটে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেগুলো উৎপাদনে আসতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগবে। ইউনিটগুলো দ্রুত উৎপাদনে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ সরবরাহের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের আগের দিন সোমবার (৩ অক্টোবর) রাত ১২টায় বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। সকাল ৭টায় তা কমে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৩৩ মেগাওয়াট। গ্রিড বিপর্যয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে দুপুর ২টায় সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ছয় মেগাওয়াট। সে সময় পূর্বাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৩৭ মেগাওয়াট। আর পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৯৬৯ মেগাওয়াট। ঠিক এর চার মিনিট পরই গ্রিড বিপর্যয় শুরু হয়। এরপর দ্রুত কমতে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। দুপুর আড়াইটায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৪১৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ মাত্র ৩০ মিনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন তিন হাজার ৫৮৮ মেগাওয়াট কমে যায়। সে সময় পূর্বাঞ্চল গ্রিডে উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ১০৩ মেগাওয়াট ও পশ্চিমাঞ্চলে তিন হাজার ৩১৫ মেগাওয়াট।

পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) সম্ভাব্য চাহিদা ছিল ১৪ হাজার মেগাওয়াট, সম্ভাব্য উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট আর সম্ভাব্য লোডশেডিং ছিল এক হাজার ১৯২ মেগাওয়াট। শুক্রবার চাহিদা কম ছিল। কিন্তু সাপ্তাহিক এ ছুটির দিনেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে নাকাল হয় মানুষ। জুম্মার নামাজের আগে ও পরে এমনকি নামাজের সময়ও বিদ্যুৎবিহীন থাকে অনেক এলাকা। দিনে-রাতে সমান তালে বিদ্যুৎ না থাকা আর অপরিকল্পিত লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ। শুক্রবার ছুটির দিনেও লোডশেডিংয়ের কারণে ক্রেতা না থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ডিপিডিসির শুক্রবারে সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের তালিকায় জুরাইন এনওসিএস এলাকায় চার ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের শিডিউল দেওয়া হয়। একই শিডিউল দেওয়া হয় কাকরাইল, মুগদা, ফতুল্লা ও শীতলক্ষ্যা এনওসিএস এলাকায়। সবচেয়ে বেশি সাত ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের শিডিউল দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা এনওসিএস এলাকায়। ডেসকোও তার আওতাধীন এলাকায় শুক্রবার ও শনিবারের জন্য তিন ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের শিডিউল প্রকাশ করে। পিডিবি সম্ভাব্য উৎপাদনের যে তথ্য দেয় উৎপাদন হয় তার চেয়ে কম।

পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হওয়ায় ঢাকার আশপাশের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। গ্রিডের সমস্যার উত্তরণ ঘটানো গেলেও সব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। এতে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন কমে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ঢাকার আশপাশের চারটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আশুগঞ্জ, হরিপুর, ঘোড়াশাল ও সিদ্ধিরগঞ্জের একাধিক ইউনিট বন্ধ ছিল। মূলত এ জন্যই লোডশেডিং বাড়ে। সব মিলিয়ে চাহিদার চেয়ে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে।

ডিপিডিসি ও ডেসকো বলছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় তাদের ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এতে সম্ভাব্য শিডিউলের বাইরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নিজাম উদ্দিন জানান, ‘জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর আমরা সতর্কতার সাথে এগুচ্ছি। লোডশেডিং পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে।’ 

সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন তার ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘মসজিদে নামাজ শুরু হওয়ার বেশ আগেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। লোডশেডিং। গত মঙ্গলবার দুপুর ২টার পর বিপর্যয় শুরু হওয়ার আগে সারাদেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠিক সেই পর্যায়ে উৎপাদনে যেতে পারেনি পিডিবি। উপরন্তু উৎপাদন আরো কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়ে গেছে অনেক বেশি। এখন বেসরকারি বা রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন শুরু করা না হলে সামনে আরো বড় দুর্ভোগ আসার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।’

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমির আলী জানান, ‘পরিস্থিতি বেশি ভালো না। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না পাওয়ায় বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। শুনেছি কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। সেগুলো চালু হলে এই সঙ্কট থাকবে না।’

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, ‘দিনে ও রাতে ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে। এতে প্রতিটি ফিডারে (নির্দিষ্ট গ্রাহক এলাকা) অন্তত দুবার, কোথাও তিনবার লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর এখনও সব পাওয়ার প্ল্যান্ট উৎপাদনে আসেনি। সে জন্যই ঘাটতি হচ্ছে।’

লোডশেডিং বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হোসাইন জানান, ‘জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে আসতে সময় লাগছে। এ জন্য লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //