সংক্রমণ কমলেও করোনা টেস্টে ভোগান্তি কমেনি

দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে- এ খবর বেশ পুরনো। তবে সংক্রমণ করলে করোনা শনাক্তে কোভিড-১৯ টেস্ট নিয়ে ভোগান্তি এখনো কমেনি, এ খবরটি আশাহত একটি বিষয়। সবচেয়ে বড় হতাশাজনক বিষয় হলো- কোভিড-১৯ টেস্টের ফি এখনো কমেনি। আবার যারা করোনা টেস্ট করছেন তাদের অনেককে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমনটাই দাবি করেছেন।

তারা বলছেন, বিশেষ করে বিদেশগামীদের বেশি ভুগতে হচ্ছে। কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে করোনা রোগী শনাক্তের আড়াই বছর পরেও কোভিড পরীক্ষার খরচ কমানো হয়নি। বেশি টাকাতেই বাধ্যতামূলক কোভিড টেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছেন বিদেশগামীরা। আর বেসরকারিভাবে করোনা টেস্টের নামে এখনো গলাকাটা ফি নেওয়া হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকায় টেস্ট করানো গেলেও চরম অব্যবস্থাপনা এবং ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাই বেসরকারি পর্যায়ে করোনা পরীক্ষার খরচ কমানোসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

করোনার টেস্ট সহজলভ্য করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। 

তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকার করোনা টেস্টের জন্য যে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটাই  নেওয়া হচ্ছে। এখানে তাদের কিছু করার নেই। 

আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, করোনা টেস্টের ফি কমানোর আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে দুইভাবে করোনার টেস্ট করা হয়। একটি হলো রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটিপিসিআর) অন্যটি অ্যান্টিজেন্ট পদ্ধতি। করোনা পরীক্ষার জন্য সরকার বেশ কয়েকবার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিদেশগামীদের এবং দেশে থাকা নাগরিকদের জন্য সরকারি ফি আলাদা। সর্বশেষ গত বছরের ৬ মে নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে সরকার। এক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল বা কেন্দ্রে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করালে তিন হাজার এবং বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হলে তিন হাজার ৭০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। প্রবাসীদের জন্য বেসরকারি হাসপাতালে ফি নির্ধারণ করা হয় ২৫০০ টাকা। অ্যান্টিজেন্ট টেস্টে লাগে ৭০০ টাকা। তখন পিসিআর কিট কমে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তো বটেই, জাতীয় পরামর্শক কমিটিও বেসরকারিতে এ পরীক্ষার ফি দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে এ মুহূর্তে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সারাদেশে ল্যাব আছে ৮৮১টি। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট আরটিপিসিআর ল্যাব আছে ১৬১টি, জিন এক্সপার্ট টেস্ট ল্যাব ৫৭টি এবং র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন রয়েছে ৬৩৬টি।

রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও আরটিপিসিআর করোনার পরীক্ষার খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা, কোথাও তিন হাজার আবার কোথাও দুই হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

নোয়াখালীর বাসিন্দা তাহমিদ আমিন বাঁধন। তিন মাসের ছুটিতে সুইডেন থেকে দেশে এসেছিলেন। ছুটি শেষ হওয়ায় আগামীকাল শুক্রবার (২১ অক্টোবর) রাতের ফ্লাইট ধরবেন তিনি। তাই ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা টেস্ট করার জন্য এসেছিলেন গতকাল বুধবার (১৯ অক্টোবর)। তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘আমি যখন পর্তুগালসহ কয়েকটি এয়ারপোর্ট ঘুরে দেশে আসি, কোথাও টেস্টের সনদ চাওয়া হয়নি। কারণ আমার বুস্টার ডোজ নেওয়া ছিল। কিন্তু আমার দেশের এয়ারপোর্টে আসতেই টেস্টের সার্টিফিকেট দেখাতে হলো। এখন আবার যাওয়ার সময় এত টাকা খরচ করে টেস্টের রিপোর্ট লাগছে, এগুলো কেন?’

রাজধানীর কলাবাগানের ল্যাবএইড ডায়গানস্টিক সেন্টারে দুবাই প্রবাসী নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলা হয়। অথচ বিমানে উঠতে-নামতে আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। পায়ের ঘাম মাথায় ফেলে আমরা কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছি। সরকারের উচিত ছিল প্রবাসীদের জন্য কমপক্ষে করোনার টেস্টটা ফ্রি করা।’

পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে করোনার টেস্ট করাতে আসা তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আমি স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় যাচ্ছি। করোনার টেস্টের নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার আড়ালে বাণিজ্য করছে। এই যে টেস্টের জন্য ২৫০০ টাকা নেওয়া হলো, এটার কি কোনো যৌক্তিকতা আছে?’ 

দাম কমানোর ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

কলাবাগানের ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকের সহকারী ব্যবস্থাপক সুরঞ্জিত সরকার বলেন, ‘করোনা টেস্টের জন্য সরকার যে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে, আমরা সেটাই নিচ্ছি। অনেক সময় কমও নেওয়া হয়।’

এ ব্যাপারে বেসরকারি একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, কোভিড টেস্টের জন্য আরটিপিসিআর মেশিনটি অনেক ব্যয়বহুল। একসঙ্গে ৫০টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতাসম্পন্ন আরটিপিসিআর মেশিনটির দাম দুই কোটি টাকা। চার ঘণ্টা পরপর কোভিডের ৫০টি নমুনা একসাথে পরীক্ষা করা যায় এ মেশিনটি দিয়ে। 

তিনি জানান, মেশিন প্রতিস্থাপন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে করোনা টেস্টের ফি বেশি নিতে হয়।

দেশে কিট সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আরটিপিসিআর কোভিড টেস্টের জন্য নাকের সোয়াপ নিতে কিটের দাম ২১০ থেকে ২২০ টাকা। কোভিড টেস্টের অ্যান্টিজেন্ট কিটের খুচরা মূল্য ৪৫০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে অ্যান্টিজেন্ট কিটের দাম ২০ টাকা কম। কিছু ক্ষেত্রে ভিটিএমসহ এর দাম এক হাজারের কিছু বেশি হতে পারে। আর বর্তমানে দেশে আরটিপিসিআর কিট ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকাতেই পাওয়া যাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এমএইচ লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ছে। টেস্ট না করালে তো প্রকৃত চিত্র জানা যাবে না। তাই সরকারের উচিত হবে সরকারি হাসপাতালে একদম ফ্রি করে দেওয়া।’

তিনি বলেন, ‘করোনার শুরুতে করোনার কিটের দাম ছিল আকাশচুম্বী। আর কিটের দাম এখন যেহেতু কম, তাই বেসরকারিতেও খরচ নাগালের মধ্যে আনা উচিত।’

বেসরকারি ল্যাব বা প্রতিষ্ঠানে পিসিআর পরীক্ষার খরচ নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘বেসরকারিতে নমুনা পরীক্ষার ফি অনেক আগে থেকেই নির্ধারণ হয়ে আছে। বিভিন্ন সময় এটি কমানো হয়েছে, তবে আপাতত ফি কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //