দেশে রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছেই

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে কোনোভাবেই দুশ্চিন্তা কমছে না। যতোই দিন পার হচ্ছে ততোই দুশ্চিন্তা বাড়ছে। একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ঠিক রাখতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে ২৭ মাসের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ঠেকেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট যেনো চারদিকে চেপে বসছে।

ডলার সংকট মেটাতে গেল ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষ হতে এখনো অনেক সময় বাকি। তবে ইতিমধ্যেই রিজার্ভ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল বৃহস্পতিবারও (২০ অক্টোবর) ৬০ মিলিয়ন বা ছয় কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বাড়ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য, গত বুধবার (১৯ অক্টোবর) ১৫৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ১৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে চলতে থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে ডলার বিক্রির হার আগের অর্থবছরকে পেছনে ফেলে রেকর্ড করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামতও তাই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গতকাল ছয় কোটি ডলার বিক্রি হয় রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের কাছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ডলারই খরচ হয়েছে সরকারি আমদানি দায় মেটাতে। কিছু নিত্যপণ্যের জন্যও ডলার দেওয়া হয়েছে। ৯৭ টাকা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকার কারণে এ পর্যন্ত রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৯০ কোটিতে। সামনে আরো কমতেই থাকবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারি করোনায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির ছিল সারা পৃথিবীর। এর ফলে আমদানি ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ ও বিদেশি অনলাইন শপ থেকে কেনাকাটা বন্ধ থাকায় ডলারের রিজার্ভ বাড়তেই থাকে। এর সাথে যোগ হয় বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয়। সারা বিশ্বের বাণিজ্য প্রায় বন্ধ থাকলেও দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ অব্যাহত থাকে। এসব কারণে গেল ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

এরপর গেল বছরের সেপ্টেম্বরে প্রায় সারা বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম আবার খুলতে শুরু করে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে বিপুল পরিমাণে। গেল অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি খাতে ব্যয় হয় ৮৪ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয়ের সাথে আমদানি ব্যয়ের পার্থক্য বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ বিলিয়ন ডলার। আমদানির এ উচ্চগতির কারণে প্রচুর ডলার বিক্রি করতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

একইসাথে প্রবাসী আয়ের ধারায় ব্যাঘাত ঘটে মারাত্মকভাবে। ২০২১ সালের আগস্টে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৮১ কোটি ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত। এর মধ্যে গেল নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৫৫ কোটি ও ফেব্রুয়ারিতে সর্বনিম্ন ১৪৯ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে ‘লেটার অব ক্রেডিট’ বা লোনপত্র খুলতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা, পড়তে যাওয়া এবং সভা-সেমিনার শুরু হওয়ায় প্রচুর ডলার প্রয়োজন হয়। যে কারণে ডলার বিক্রির হার আরো বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর ফলে বেড়ে যায় তেলের দাম। ৭৪ ডলার ব্যারেলের তেল দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ ডলারে। এ কারণে তেল আমদানির খরচ বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। নিত্যপণ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমদানির জন্য বিলাসপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহী করতে বেশ কিছু পণ্যে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত এলসি মার্জিন আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘ডলার সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছিল। তবে তা একটু দেরি করে নেওয়ায় বেশি ডলার ব্যয় হয়ে যায়। এর মধ্যে করোনার পরে বিমান চলাচল চালু হয়। যে কারণে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও কেনাকাটা বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু ২০২১ সালের আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত অনলাইন কেনাকাটায় খরচ হয় তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি সমপরিমাণ ডলার। এসব যদি আগে লক্ষ্য করা যেত তবে আরো বেশি ডলার সংরক্ষণ করা যেতো।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘করোনায় সারা বিশ্বের ব্যবসা বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ কিন্তু ব্যবসা করেছে। প্রচুর আরএমজি (তৈরি পোশাক) এক্সপোর্ট হয়েছে এ সময়ে। ঠিক একই সময়ে আমদানি এবং বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ ছিল। সে সময় বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যেতে হয়নি। এতে প্রচুর ডলার বেঁচে যায়। কিন্তু এখন তো সব ওপেন। বিদেশ ভ্রমণ কমাতে সরকারের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। সরকারি সফরও বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া অ্যামাজন, আলী বাবা, ফ্লিপকার্ট ও অন্যান্য সাইট থেকে কেনাকাটা বন্ধ থাকায় ডলার সেভ হয়। এতে করে রিজার্ভ বেড়ে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘রিজার্ভ বেড়ে যাওয়ায় একটা পক্ষ স্বস্তির ঢেকুর তোলে। কিন্তু কেউ পরবর্তী চ্যালেঞ্জের কথা ভাবেনি। যার পরিণতি এখন পেতে হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই আমরা বলছি বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করতে। আমরা সতর্ক করেছি, কিন্তু আমাদের কথা আমলে নেওয়া হয়নি। হাই প্রাইসের নানা পণ্য আমদানিতে লোন না দেওয়ার জন্য। এসব বিষয়ে সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় অলরেডি ডলার চলে যায়। ট্রেড ডিফিসিট (আমদানি-রপ্তানি ব্যয়ের পার্থক্য) বেড়ে ৩০ বিলিয়ন (মূলত ৩২ বিলিয়ন) ডলার ছাড়ায়। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে রিজার্ভ এতো কমত না। এর পাশাপাশি আমরা এখনো বলে চলেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি বন্ধ করা উচিত। কিন্তু তা কর্ণপাত না করে ডলার বিক্রি আরো বেড়েই চলেছে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ডলার বিক্রি করতে হয় দেশের আমদানি ব্যয় মেটাতেই। সেন্ট্রাল ব্যাংক ডলার বিক্রি করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে। এসব ব্যাংক সরকারি দায় মেটায়। ডলার বিক্রি না করলে তেল ও গ্যাস আমদানি হবে কোত্থেকে?’

তিনি আরো বলেন, ‘রিজার্ভ কমছে এটা সত্য। তবে আমরা আশা করছি রিজার্ভ আবার বাড়বে। সংকট থাকবে না রিজার্ভে।’

এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বা ইডিএফে সাত বিলিয়নসহ আরো বেশ কিছু প্রকল্পে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার ফান্ড গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ফান্ডের বেশিরভাগ টাকাই ফেরত আসেনি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র মতে, এই আট বিলিয়ন ডলারসহ রিজার্ভের হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইডিএফ ফান্ডে দেওয়া রিজার্ভ ডলার আকারে আর ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। আসবে টাকা হিসেবে। তাই সে টাকা এলে রিজার্ভ হিসেবে কাউন্ট হবে না।

একই মত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফেরও। সংস্থাটির কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে। ঋণ দেওয়ার জন্য রিজার্ভের হিসাব থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে বলেছে সংস্থাটি। এই আট বিলিয়ন বাদ দিলে বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় দুই হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //