ধসের পথে জ্বালানি খাত

খরচ করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না গ্যাসে। সক্ষমতা অনুসারেই গ্যাস মিলছে না। যার ফরে ভুগছে গোট দেশ শিল্পকারখানা যেমন স্থবির হয়ে পড়ছে তেমনি দেশের অর্থনীতিতে নেমেছে ধস। 

সাগরে ভাসমান দুটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারে। এখন সেখান থেকে মাত্র ৩৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এটি সক্ষমতার ৩৮ শতাংশ। তবে সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার না হলেও এলএনজি টার্মিনালকে বসিয়ে রেখে সরকার ভাড়া দিচ্ছে। এজন্য সরকারের দৈনিক ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি টাকা।

দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি ও অন্যটি দেশীয় কোম্পানি সামিটের। তবে দুটি টার্মিনালেই জাহাজ ও লোকবল দিয়ে পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি।

সূত্র জানায়, সরকার দুটি টার্মিনালের সক্ষমতার মাত্র ৪২ শতাংশ এলএনজি কেনার বিষয়টি দুটি দেশের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করেছে। বাকি ৫৮ শতাংশ স্পট বা খোলাবাজার থেকে কেনার জন্য রাখা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে আনা এলএনজির প্রতি ইউনিট দাম সাড়ে ১১ থেকে প্রায় ১৩ ডলার। আর স্পট মার্কেটের এলএনজির দাম বর্তমান ৩৫ থেকে ৪০ ডলারে ওঠানামা করছে। এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় টার্মিনাল দুটি সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে লোডশেডিং বেড়েছে। গ্যাসের অভাবে অন্তত তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। শিল্পকারখানায় গ্যাসের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

এদিকে, পেট্রোবাংলার সাথে সামিট ও এক্সিলারেট এনার্জির করা চুক্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটি টার্মিনাল দিয়ে দৈনিক পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। এজন্য প্রতিটি টার্মিনালকে যন্ত্রপাতি বিনিয়োগের জন্য দৈনিক এক লাখ ৫৯ হাজার ১৮৬ ডলার দিতে হবে। টার্মিনালের পরিচালনা ব্যয়ের জন্য প্রতিদিন দিতে হবে ৪৫ হাজার ৮১৪ ডলার। এছাড়া টাগবোট ও টার্মিনালের যে ভাসমান বন্দর করা হয়েছে তার ফি হিসাবে দৈনিক দিতে হবে ৩২ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে প্রতিটি টার্মিনালকে দৈনিক দিতে হয় দুই লাখ ৩৭ হাজার ডলার বা আড়াই কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা এই অর্থ টার্মিনাল ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বলেন।

পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, গত ১৩ অক্টোবর থেকে গত ২৩ অক্টোবর দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক এলএনজি গড়ে ৩৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে। এতে টার্মিনালের সক্ষমতার ৩৮ শতাংশ ব্যবহার করা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী এই সময় টার্মিনালের ক্যাপাসিটি ভাড়া দিতে হয়েছে শতভাগ। অথচ গত বছরের এই সময়ে দুটি টার্মিনাল থেকে ৮০ থেকে ৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হতো।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে তার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিচ্ছে সরকার। এখন আবার একই আদলে জ্বালানি খাতেও লুটপাট হচ্ছে। এটি আসলে গণলুটপাটের একটি মডেল, যা স্পট মার্কেট থেকে বেশি গ্যাস কেনার জন্য রাখা হয়েছে। কেননা, এখান থেকে সংশ্লিষ্টরা কমিশন বেশি পান।’

রিজার্ভ সংকট ও ভবিষ্যতের খাদ্য সংকটের কথা বিবেচনা করে সরকার আমদানিতে কৃচ্ছ্রসাধন করছে। এরই অংশ হিসেবে খোলাবাজার থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস ৩৫ থেকে ৪০ ডলারে কিনতে রাজি নয় সরকার। গ্যাস সংকটের কারণে দৈনিক প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। দেশের কলকারখানায় তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এমনকি বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। দেশে প্রকৃত গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৭০ কোটি ঘনফুট। তবে সংকট শুরুর আগে সরবরাহ করা হচ্ছিল ২৯০ কোটি ঘনফুটের মতো। সেটি নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। প্রয়োজনের তুলনায় অন্তত ৩০ শতাংশ গ্যাস কম সরবরাহ হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার শীর্ষ কর্মকর্তা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, খোলাবাজার থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস ৩৫ ডলারে আমদানি করা কোনোভাবেই এই দেশের পক্ষে সম্ভব না। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী, কাতারের কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে সব মিলিয়ে ১৩ দশমিক এক ডলারে। আর ওমানের কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে ১২ দশমিক ৩ ডলারে। গত এক সপ্তাহে খোলাবাজারে বা স্পট মার্কেটে এলএনজির প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যখন এলএনজি আমদানির জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হচ্ছিল তখন খোলাবাজারে এলএনজির দাম দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির দামের চেয়েও কম ছিল। সে কারণে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অংশে এলএনজির পরিমাণ কম রাখা হয়েছে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দুনিয়াতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে মোট ক্ষমতার ৮০ শতাংশ এলএনজি আমদানি করা হয়, আর বাকি ২০ শতাংশ রাখা হয় খোলাবাজারের নিম্নদামের সুবিধা নিতে। বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে আনা হচ্ছে ৪২ শতাংশ ও খোলাবাজারে রাখা হয়েছে ৫৮ শতাংশ। এই ভুল নীতির কারণেই জ্বালানি খাত এখন ডুবতে বসেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //