দেশের ৬০ শতাংশ শিশুর শরীরে সিসা

দেশের ৬০ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসা ঢুকে গেছে। সংখ্যাটি ৩ কোটি ৬০ লাখ। এই শিশুরা রক্তে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের এক কোটির প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসা পাওয়া গেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের শরীরে শতভাগ সিসার উপস্থিতি রয়েছে। 

গবেষকরা বলছেন, বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে এ সিসার নেতিবাচক প্রভাব বেশি। সিসার প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। কোনো বিষয়ের প্রতি গভীর মনোযোগে বাধা প্রদান করে, লেখাপড়ায় দুর্বল হয়ে পড়ে মনোযোগের অভাবে, ফলে এক সময় ড্রপআউট (ঝরে পড়া) হয় বিদ্যালয় থেকে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি থাকে, বড় হয়ে এরা যে কোনো বিষয়ে আগ্রাসী হয়ে ওঠার শঙ্কাও প্রবল। এই শিশুদের অপরাধ জগতেও জড়িয়ে পড়তে সহায়তা করছে সিসা। 

আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থা ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) যৌথ গবেষণায় বলা হয়, দেশের চার জেলায় শিশুদের রক্তে সিসার সক্রিয় উপস্থিতি মিলেছে। সিসার উপস্থিতি থাকা শিশুদের ৬৫ শতাংশের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সিসা রয়েছে। এই ৬৫ শতাংশ শিশু রয়েছে উচ্চঝুঁকিতে।

উল্লেখ্য, সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন। এ ধরনের নিউরোটক্সিন (মস্তিষ্কের জন্য বিষাক্ত পদার্থ) শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। মস্তিষ্কের পুরোপুরি বিকাশ হওয়ার আগেই এর ক্ষতিসাধন করে। এতে শিশুরা যতদিন বেঁচে থাকবে (অর্থাৎ বয়স্ক হওয়ার পরও) স্নায়ুবিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধিকতার সম্মুখীন হতে পারে। মারাত্মক সিসা দূষণ অনেক সময় মৃত্যুরও কারণ হয়।

বাংলাদেশে সিসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস পুরনো সিসাযুক্ত অ্যাসিডক ব্যাটারির অবৈধ রিসাইক্লিং কারখানা। বিপজ্জনক এবং প্রায়ই অবৈধ পুনর্ব্যবহারমূলক কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মীরা ব্যাটারির খোলস ভেঙে একে উন্মুক্ত করেন। এ কারণে অ্যাসিড ও সিসার ধূলিকণা মাটিতে পড়লে কর্মীরা অপরিশোধিত সিসা উন্মুক্ত চূল্লিতে গলান। এই গলানোর কারণে বিষাক্ত ধোঁয়ায় আশপাশের কমিউনিটিতে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। সিসা যে একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন সে সম্পর্কে প্রায়ই কর্মী এবং সংস্পর্শে থাকা কমিউনিটি সচেতন নয়।

নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে সিসাজনিত বিষক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রাখে সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলোর অনানুষ্ঠানিক ও নিম্নমানের পুনর্ব্যবহার। বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর থেকে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সিসার মাত্রা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যানবাহনের মালিকানা বৃদ্ধির পাশাপাশি গাড়ির ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারবিষয়ক নিয়মকানুন ও অবকাঠামোগত ঘাটতি অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রায় ৫০ শতাংশ সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি অনিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহার করে।

সিসা বিষয়ে গবেষণায়যুক্ত গবেষকরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধবিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রা ৩.৫ মাইক্রোগ্রাম। সিডিসি বলছে, কারও শরীরে এর চেয়ে বেশি সিসার উপস্থিতি থাকলে তা ক্ষতিকর বলে বিবেচিত; কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বলছে, মানবদেহে সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। রক্তে সিসার উপস্থিতি থাকা মানেই তা ক্ষতি বয়ে আনে।

অন্যদিকে সিসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর হারের দিক থেকে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সিসা দূষণের কারণে প্রতিবছর ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে অর্থাৎ- সিসা দূষণে বছরে ৩.৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। সিসা দূষণের কারণে যে পরিমাণ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় তাতে বার্ষিক ১৬০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয় দেশের। এই পরিমাণ টাকা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়কৃত অর্থের প্রায় অর্ধেক।

আইইডিসিআরের গবেষক নওরোজ আফরিন গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, টাঙ্গাইল, খুলনা, সিলেট, পটুয়াখালী- এই চার জেলার শিশুদের ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। পরীক্ষার আওতায় আসা ৯৮০ শিশুর সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিশুরই রক্তে সিসার মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি নির্ধারিত মাত্রা ৩.৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি। এর মধ্যে ২৪ মাস থেকে ৪৮ মাস বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরেই সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

আইসিডিডিআরবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় তারা ৫০০ শিশুর রক্ত পরীক্ষা করেছেন। তাদের সবার শরীরেই সিসার উপস্থিতি মিলেছে। ৯৬ পণ্যে সিসার উপস্থিতি পেয়েছেন আইসিডিডিআরবির গবেষকরা। গবেষণায় বাজারের বিভিন্ন পণ্যও পরীক্ষা করা হয়। ৩৬৭টি পণ্যে পরীক্ষা চালিয়ে ৯৬টিতে সিসার উপস্থিতি মিলেছে।

চারটি শহরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিশুদের খেলনা, সব ধরনের রং, অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিল, সবজি, চাল এবং মসলার নমুনায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। চার শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনা। এ ছাড়া মাটি, ছাই, পোড়ামাটি ও হলুদের গুঁড়ায় সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে। দেয়ালের রং, পানির পাইপ ও ফিটিংস, কসমেটিকস ও সিঁদুরের গুঁড়া, মাছ ধরার জাল, কোমল পানীয়র ক্যান, ইলেকট্রনিকস বর্জ্য, হার্বাল ওষুধ, গহনা প্রস্তুতকারক ও স্বর্ণ প্রক্রিয়াজাতকারক ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সিসা খাদ্য, পানীয় ও ত্বকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। যা শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

গ্রামের ৩০ শতাংশ গর্ভবতী নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সিসামিশ্রিত হলুদের গুঁড়া গর্ভবতী নারীর শরীরে উচ্চমাত্রার সিসার উপস্থিতির কারণ। 

হলুদ ও মরিচের গুঁড়ায় সিসা থাকে কেন

ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের গবেষকরা জানিয়েছেন, হলুদ ও মরিচে সিসা থাকে না। তা হলে হলুদ ও মরিচের গুঁড়ায় সিসা আসে কোথা থেকে? এই প্রশ্নের জবাবে কমিউনিটি হাসপাতালের গবেষকরা বলেন, নিম্নমানের হলুদ ও মরিচ ভাঙালে এর যে রং হয় তা দেখলে ক্রেতা কিনতে চায় না। ক্রেতাকে আকর্ষণের জন্য হলুদ ও মরিচগুঁড়া ব্যবসায়ীরা হলুদ ও মরিচগুড়ায় সিসা মিশিয়ে দেয়। এটা করলে এই দুই মশল্লার পাউডার চকচক করতে থাকে। এই পাউডার ক্রেতাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় এবং তারা বেশি কিনে থাকেন। এভাবে হলুদ ও মরিচে সিসা আসে। ইউসেফের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু চক চক করার জন্যই নয়, সিসা মেশালে হলুদের ওজনও বাড়ে।

শরীরে জমা সিসা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। স্নায়ুবিক ও দেহগত বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সিসা পাইলস, ফিস্টুলা, গ্যাস্ট্রিকের বা আলসার, লিভার বা কিডনির রোগ বাড়াবে। প্রায় সবধরনের অসুখের কথাই জানতে পারছি সিসার অতিব্যবহার থেকে। সবচেয়ে ভয়ের কথা- গর্ভবতী নারী ও গর্ভের ভ্রূণের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় এটি। গর্ভবতী নারীর রক্তে অতিরিক্ত সিসা অপরিণত শিশু জন্মের কারণ হতে পারে। লক্ষ করলে দেখবো যে, বেশ কয়েক বছর থেকেই অসুস্থ, অপরিণত, প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক বাচ্চা জন্ম নেওয়ার হার বাড়ছে। 

ইউনিসেফ বলেছে, সিসার বিষক্রিয়া শিশুদের জীবনভর শিক্ষাগ্রহণে অসামর্থ্য করে। একই সাথে এদের স্বাস্থ্য-বিকাশের ওপর মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এবং এর কারণে বড় হওয়ার পর তাদের আয়ের সক্ষমতা কমে যায়। বিপজ্জনক ধাতব বর্জ্য ও সিসার দূষণে শিশুদের ক্ষতিজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।

ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স ইভাল্যুয়েশনের তথ্য অনুসারে সিসার বিষক্রিয়াজনিত কারণে বিশ্বে যেসব দেশে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ২০২০ সালে ইউনিসেফের সহায়তায় আরেকটি গবেষণায় এদেশের জনসংখ্যার প্রত্যেকের রক্তে সিসার উপস্থিতির গড়হার প্রতি ডেসিলিটারে ৬.৮৩ মাইক্রোগ্রাম। ২০২০ সালে এটা ছিল সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বিশ্বে ১১তম।

সিসার কারণে বাংলাদেশের শিশুদের আইকিউ হ্রাস পাওয়ায় অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হয় তা দেশের জিডিপির ৫.৯ শতাংশের সমান। সিসার বিষক্রিয়া শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের সক্ষমতাকে ব্যাহত করে এবং জীবনে পাওয়া সুযোগগুলোর সর্বাধিক সুবিধা গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শৈশবকালীন সিসাজনিত বিষক্রিয়া মানসিক স্বাস্থ্য ও আচরণগত সমস্যা এবং অপরাধ ও সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গেও সম্পর্কিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বড় শিশুরা পরবর্তী জীবনে কিডনি নষ্ট হওয়ার এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিসহ ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করে। শৈশবকালীন সিসাজনিত বিষক্রিয়ার শিকার হওয়া শিশুদের জীবনভর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //