হয়নি মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ তালিকা, রাজাকারের তালিকা কতদূর

ঘোষণার ২০ মাস পার হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারেনি সরকার। একই সঙ্গে পথ হারিয়েছে রাজাকারের তালিকা করার উদ্যোগও।

যদিও ইতোমধ্যে দফা দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার কাজ শেষের দিকে। মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) ছাড়া অন্য ক্যাটাগরির মুক্তিযোদ্ধার আবেদন নেওয়া ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

গত ১৮ মে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। তবে যে সব আবেদন ইতোমধ্যে গৃহীত হয়েছে এবং যাচাই-বাছাই বা আপিল পর্যায়ে রয়েছে সেসব আবেদন নিষ্পন্ন করার কাজ যথারীতি চলমান থাকবে। এ কাজ শেষ হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পূর্ণাঙ্গ হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তারা।

গত বছরের ২৫ মার্চ ঘোষণার পর চলতি বছরের ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কথা ছিল। কিন্তু সেটাও আর সম্ভব হয়নি। চলতি (ডিসেম্বর) মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার গেজেট প্রকাশ হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রবল আপত্তি ও সমালোচনার মুখে পিছু হটতে হয়েছে মন্ত্রণালয়কে। স্থগিত করা হয় সেই তালিকা।

এখন রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীদের তালিকা করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর মন্ত্রিসভা বৈঠকের অনুমোদন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর গত ৭ সেপ্টেম্বর নতুন ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ জারি করা হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ নির্ভুল তালিকা করতে পারেনি। বহুবার তালিকা-সংযোজন বিয়োজন করে প্রকাশ করা হয়েছে। সব সরকারের সময় ক্ষমতার দাপটে কিছু লোক জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধার মানদণ্ড বদল হয়েছে বারবার।

গত বছরের ২৫ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চ‚ড়ান্ত তালিকার প্রথমটি প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ তালিকায় স্থান পান এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এরপর দ্বিতীয় তালিকায় স্থান পান আরও ৬ হাজার ৯৮৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই তালিকা প্রকাশ করা হয় ৯ মে। 

এরপর গত ৭ জুন তৃতীয় তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেই তালিকায় স্থান হয় আরও ১২ হাজার ১১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার। গত বছরের ২৪ জুন প্রকাশিত তালিকায় ৮ বিভাগের ৫৫ উপজেলায় ২ হাজার ৯৭৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরও তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, এতে স্থান পেয়েছেন সর্বমোট এক লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা।

একজন মুক্তিযোদ্ধা ২০ হাজার টাকা হারে মাসিক ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়া ১০ হাজার টাকা করে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ভাতা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবস ভাতা ও ২ হাজার টাকা নববর্ষ ভাতা পেয়ে থাকেন।

সব বীর মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করছে। এতে অনিয়ম বন্ধ হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যায়। আগে প্রায় ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা দেয়া হতো। 

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের সাধারণভাবে রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন- হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের তালিকা করা হয়নি।

শেষে ২০১৯ সালে বিজয় দিবসের আগের দিন (১৫ ডিসেম্বর) ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ঘোষিত তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর আরও দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে ওই তালিকায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা শুরু হয়।

আপত্তি ও সমালোচনার মুখে তিন দিনের মাথায় রাজাকারের তালিকা স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলেও জানান মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপর আর এ বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।

রাজাকারের তালিকার বিষয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সাব-কমিটি রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ করছে। 

ইতোমধ্যে নেওয়া আবেদন যাচাই-বাছাই বা আপিলগুলো নিষ্পত্তি হলে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি। রাজাকারের তালিকার বিষয়ে সংসদীয় উপ-কমিটির আহ্বায়ক শাজাহান খান ও সদস্য এ বি তাজুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে রাজাকারদের তালিকা তৈরিতে চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন সংসদীয় সাব কমিটি গঠন করা হয়। শাজাহান খান নতুন এ সাব কমিটির আহ্বায়ক হন। এর অন্য দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //