প্রাণহীন হচ্ছে তুরাগ

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে রাজধানীর সীমান্ত দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে তুরাগ নদ। মাঝে ঢাকার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে ভাগ হয়েছে দুটি ধারায়। মূল শাখাটি আমিনবাজার হয়ে পড়েছে বুড়িগঙ্গা নদীতে, অন্য শাখাটি বিরুলিয়া থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে বালু নদীতে গিয়ে মিশেছে।

ঢাকাকে ঘিরে রাখা এ নদের কোথাও দুই ধারে বড় বড় দালান আর মিল-কারখানা, কেমিক্যাল মেশানো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত কালো পানির স্রোত, আবার কোথাও কালো ধোঁয়া ওড়ানো ইটভাটার চিমনি, ময়লা-আবর্জনা কিংবা কচুরিপানার জটলা। এ যেন এক বিষের নহর!

সরেজমিনে দেখা যায়, আবদুল্লাহপুর ব্রিজ থেকে শুরু করে তুরাগ নদী বন্দর পর্যন্ত পুরো এলাকাতেই সরাসরি এই নদে ফেলা হচ্ছে শিল্প-কারখানার বর্জ্য। বিশেষ করে তুরাগ বন্দর থেকে বালু নদী পর্যন্ত পুরো অংশই যেন পলিথিন ও ভারী আবর্জনায় পূর্ণ। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতি। একই সঙ্গে ড্রেন দিয়ে সরাসরি তুরাগে গিয়ে পড়ছে পয়ঃবর্জ্য ও জবাইকৃত পশুর বর্জ্য। ফলে দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে এর পানি। দিন দিনই কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। আর এমনটা চলতে থাকলে দ্রুতই প্রাণহীন হবে ঢাকার তুরাগ। কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীই আর তুরাগের জলে বেঁচে থাকবে না বলে মনে করছেন গবেষকরা। 

এলসেভিয়ারের এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস জার্নালে ‘ইকো-এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট অব দ্য তুরাগ রিভার ইন দি মেগাসিটি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে বিভিন্ন তথ্য। তুরাগ নদীর ১০ স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ওয়াটার কোয়ালিটি ইনডেক্স ও (ডব্লিউকিউআই) ও রিভার হ্যাবিটটি সার্ভে (আরএইচএস) পদ্ধতি অনুসরণ করে এ গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণাটিতে চারজনের দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সহকারী অধ্যাপক আলমগীর কবির।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকা মেগাসিটিতে শিল্পায়নের ফলে ত্বরিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দ্রুত নগর সম্প্রসারণ এবং জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে তুরাগের সার্বিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ফলে নদীর পরিবেশের উপর বিভিন্ন হুমকি তৈরি হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনের আরও উঠে এসেছে, পানির স্বচ্ছতা (টার্বিডিটি) কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে সব জায়াগাতেই অস্বচ্ছ। এ ছাড়া তুরাগের শতভাগ স্থানের পানিই মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য। ৩০ শতাংশ জায়গা জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য অনুপযোগী। 

জরিপে এসেছে, নদীর বিভিন্ন প্রান্তে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ জায়গায় শিল্পের বর্জ্য ফেলতে দেখা গেছে এবং ৯০ থেকে শতভাগেই হচ্ছে পয়ঃনিষ্কাশন। এছাড়া নদীর ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ জায়গায় অতিমাত্রায় বিভিন্ন আবর্জনা দেখা গেছে। ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, নদী দখল, পৌরসভা শহর ও শিল্পের পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদির কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এছাড়া অতিমাত্রায় নদীর চ্যানেল সংস্কারে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা তৈরি হয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে তুরাগ নদের অবস্থাও বুড়িগঙ্গার মতো হবে বলে জানান গবেষকরা। 

অধিকাংশ পানির গুণমান সূচক যেমন পিএইচ, ইলেকট্রিকাল কনডাক্টিভিটি (ইসি) স্যালিনিটি (লবণাক্ততা), টোটাল ডিজলভ সলিড (টিডিএস-দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ) অধিকাংশ কেশনস (ক্যাটায়ন বা ধনাত্মক চার্জযুক্ত আয়ন) এবং অনিয়ন (অ্যানায়ন বা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত আয়ন) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের স্ট্যান্ডার্ডে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে বলেও গবেষণায় এসেছে। 

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর সহকারী অধ্যাপক আলমগীর কবির বলেন, ‘কলকারখানার অতিরিক্ত জৈব বর্জ্য এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকার কারণে তুরাগে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ, বিশেষ করে কচুরিপানার উপস্থিতির কারণে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। মূলত নদীতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকার কারণে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ বিশেষ করে অতিরিক্ত কচুরিপনা তুরাগের দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমার জন্য দায়ী। একই সঙ্গে পানিতে দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ জলজপ্রাণীর স্বাভাবিক শ্বাসকার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত অক্সিজেন স্বল্পতা এবং দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ জলজপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে প্রথমেই ঢাকা ও এর আশপাশে অবস্থিত শিল্প কল-কারখানাগুলোকে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা (ইটিপি) ব্যবহারে বাধ্য এবং তা নিয়মিত মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতকল্পে নদীর দখলকৃত স্থাপনা অপসারণ এবং স্থায়ী সীমানা দিতে হবে। সর্বোপরি, রাজধানী ঢাকার সীমানায় অবস্থিত তুরাগসহ অন্যান্য নদীকে রক্ষায় একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনাই নদীকেন্দ্রিক এ শহরের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে।’

এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘তুরাগ নিয়ে সরকার যত পরিকল্পনা নিয়েছে সবই আংশিক। শুধু দূষণ নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন দেখিনি, সবই কথার মধ্যে আছে।

যেখান থেকে তুরাগ দূষণ হচ্ছে সেটাকে মাথায় না এনে শুধু ডাউনস্ট্রিম সংস্কার করে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব না। তুরাগের মূল দূষণ হচ্ছে শ্রীপুর, কাশিমপুর, বংশী ও ইপিজেড থেকে। অথচ যত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সব আশুলিয়া থেকে। ভবিষ্যতে তুরাগের অবস্থা বুড়িগঙ্গার চেয়ে খারাপ হতে পারে।’ 

তুরাগ এখন নদী নেই, দখলে ও দূষণে এটা যেন নর্দমায় পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘দিনে দিনে তুরাগ নদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আগে এটা ছিল কোহর দরিয়া, পরে হয়েছে তুরাগ নদ। এখন দখলে দূষণে এটা নর্দমায় পরিণত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তুরাগকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এটির উজানে যেসব সংযুক্ত নদী ও খাল আছে, সেগুলোকে আগে বাঁচাতে হবে।

নদীতে পোশাক শিল্পের বর্জ্য পড়ছে সরাসরি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্যানারির বর্জ্য। তুরাগ দূষণের কারণে পাড়ের মানুষের জীবনে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে। কাজেই এখন নদী দূষণ শুধু ঢাকার নগরকেন্দ্রিক নেই। ঢাকার চারপাশের মানুষের জীবনেও এর প্রভাব পড়ছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //