রাবার কোম্পানির অত্যাচারে দুর্বিষহ ম্রোদের জীবন

বান্দরবানের পাহাড় অধ্যুষিত লামা এলাকাটিতে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে ম্রো জনগোষ্ঠী। এর প্রায় ৪০০ একর জমিতে জুমচাষ, বাগানসহ নানা আবাদ তাদের। বছরের পর বছর শান্তিতে বাস করলেও সম্প্রতি লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে এক প্রতিষ্ঠান এসব জমি দখলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যে কয়েকবার জমির গাছ ও ফসল কাটা এবং বাড়িঘরে আগুন-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় প্রশাসনিক তৎপরতাও যথেষ্ট নয় বলে জানা যাচ্ছে।

সবশেষ গত ২ জানুয়ারি লামায় ম্রোদের বাড়িঘরে আগুন-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এদিন রাত একটার দিকে পাঁচ থেকে ছয়টি ট্রাকে বহিরাগত ব্যক্তিরা এসে এই হামলা চালায়। লামার সরই ইউনিয়নের রেঙয়েন কার্বারি পাড়ায় বসবাসকারী ও হামলার শিকার ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের অভিযোগ, তাদের বসবাসের শেষ অবলম্বন ৪০০ একর জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার জন্যই লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়েছে।

জমি কার

লামার বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি প্রকৃতপক্ষে ম্রো ও ত্রিপুরাদেরই ছিল। সেখানে তারা জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। আর জুম চাষের বৈশিষ্ট্যই এমন- এর জন্য স্থায়ী ব্যক্তিগত ভূমি মালিকানার প্রয়োজন পড়ে না। কোনো একটি পাড়ার আওতায় থাকা জুম চাষের জমি বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং টানা দু-তিন বছর চাষাবাদের পর উর্বরতা পুনরুদ্ধারে সেই জমি কয়েক বছরের জন্য ফেলে রাখতে হয়। এভাবে কয়েক বছর পরপর পাড়ার জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গা এবং প্রতিটি পরিবারের জুমের ক্ষেতও বদলে যেতে থাকে।

কিন্তু পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার অগ্রাহ্য করে গত শতকের ৮০-৯০ দশকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব জমি বাণিজ্যিক প্ল্যান্টেশনের জন্য বহিরাগতদের লিজ দেওয়া হয়। এতে ওই জুম ভূমি থেকে একদিকে ম্রো ও ত্রিপুরার লোকজন উচ্ছেদ হতে থাকে। অন্যদিকে রাবার, টিক ইত্যাদির মনোকালচার প্ল্যান্টেশনের প্রভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ডলুছড়ি ও সরাই মৌজার মোট ১ হাজার ৬০০ একর জমি লিজ দেওয়া হয়।

সংকটের শুরু

লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ বাস্তবে ৩ হাজার একরেরও বেশি জমিতে রাবার বাগান করেছে। এখন যে ৪০০ একর জমি থেকে ম্রো ও ত্রিপুরাদের উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে; সেটিও লিজের আওতার বাইরের জমি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমি থেকে উচ্ছেদ করতে ২০২২ সালের ২৬ মার্চ সেখানে লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়ায় মোট ৩৬টি পরিবার বসবাস করা ৪০০ একর জায়গায় রাবার ও কাজু বাদাম চারা লাগানোর জন্য লামা রাবার কোম্পানি আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে প্রায় ৩৫০ একর বনভ‚মি পুড়ে বিরান হয়ে যায়।

এছাড়া একই বছরের এপ্রিল মাসে তাদের বাগানে লাগানো বিভিন্ন ফলদ চারা যেমন- আনারস, বরই, আম, জাম, কাঁঠাল গাছ, বাঁশবাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে দেওয়া হয় এবং জমিতে আগুন দিয়ে ফসল ধ্বংস করে তাদের খাদ্য সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। এরপরে ৬ সেপ্টেম্বর রেংয়েন পাড়াবাসীর ব্যবহারের একমাত্র পানির উৎস ঝিরির উজানে বিষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। একই মাসের ২৫ সেপ্টেম্বর ম্রো পাড়ার ৩০০ কলাগাছ কেটে ফেলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রির লোকজন।

২ জানুয়ারি যা ঘটেছে

জমি থেকে উচ্ছেদ করতে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের মধ্যেই গত ২ জানুয়ারি ট্রাকভর্তি লোকজন এসে পাড়ার আটটি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হামলা করে।

রেংয়েন ম্রোদের পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) রেংয়েন ম্রো সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “রাতে কয়েকশ লোক হঠাৎ করে এসে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। পরে তিনটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। কয়েকটি ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে।” 

তিনি বলেন, রাতে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাড়ার লোকজন দেখেছে, পাড়া থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ছয়টি ট্রাক দাঁড়ানো ছিল। ট্রাকের লোকজনের হাতে একটা করে লাঠি ও দা ছিল। আমাদের ধারণা, ছয়টি ট্রাকে অন্তত দুইশ থেকে আড়াইশর মতো লোক থাকবে।

ক্ষতিগ্রস্ত রেংওয়াই ম্রো বলেন, পাড়ার কারবারিসহ কয়েকজন মিলে ঠান্ডার কারণে আগুন পোহাচ্ছিলাম। রাবার কোম্পানির লোকজন এসে প্রথমে আমার ঘরে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কারবারিসহ আমরা দুজন ঝিরিতে লুকিয়েছিলাম। আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে অন্যদিকে পালিয়ে যায়। সকালে এসে দেখি আমার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে আছে। এমনকি তিনটা বাচ্চাসহ একটি মা ছাগল ছিল। তারা মা ছাগলটাকে ধরে নিয়ে যায়। পরিবারের সবাই সকাল থেকে আধপেটা হয়ে ছিলাম।

পাড়ার কারবারি রেংয়েন ম্রো এ প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনার দিন রবিবার সকালেও রাবার কোম্পানির লোক আব্দুল মালেক ও দেলোয়ারদের সঙ্গে শামীম নামে এসআই পাড়ায় এসেছিলেন। অথচ ওই রাতেই আবার পাড়ায় আগুন লাগানো ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

যা বলছে প্রশাসন

ম্রো পাড়ায় একের পর এক ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা মেলেনি। ২ জানুয়ারি রাতের ঘটনার পর সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছিলেন কেয়াজু বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শামীমসহ পুলিশের সদস্যরা।

এসআই শামীম বলেন, এখানে দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি ম্রো সম্প্রদায় আর অন্যটি রাবার কোম্পানি। আইনশৃঙ্খলা অবনতির জন্য যে কোনো পক্ষ অভিযোগ দিলে আমরা সেখানে যাই। খবর পেয়ে সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছি। এ ঘটনার জন্য পাড়াবাসী রাবার কোম্পানির ব্যাপারে অভিযোগ দিচ্ছে। আমরা তদন্ত করব। 

পুলিশের লামা সার্কেলে এসএসপি আনোয়ারুল ইসলাম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, এক কথায় হার্ড দ্য নিউজ, রিসিভ দ্য নিউজ। এরপর ইনভেস্টিগেশন। এরপর আরও ভালো জানবে ওসি ও এসপি (পুলিশ সুপার)।

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, সর্বশেষ অবস্থা পর্যন্ত সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ওসি এবং কেয়াজু পাড়ার পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রবিবারও কথা বলেছি। ঘর পোড়ানোর ব্যাপারে পুলিশ একটা টোটাল রিপোর্ট দেবে। সেগুলো আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব।

তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ব্যাপারে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বা কোনো সিদ্ধান্ত আসলে তা দেওয়া হবে। তবে আগে থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল পাড়াবাসী ও রাবার কোম্পানি যার যার অবস্থানে যেন থাকে। বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে নতুন করে কোনো কিছু স্থাপনা করা যাবে না বলা হয়েছিল।

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বক্তব্য

বরাবরের মতোই ম্রো পাড়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইফতেখার আলম মজুমদার বলেন, অনেক সময় তারা (ম্রো) নিজেরা বাড়িঘর ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে আমাদের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা করে। আমাদের রাবার কোম্পানি কোনোভাবেই এ ধরনের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগর সঙ্গে জড়িত নয়।

তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে পাড়াবাসী সেখানে কয়েকটা ঘর তুলেছেন বলে আমাদের কর্মচারীরা জানান। এ বিষয়ে আমরা থানায় অভিযোগ করি। আজ দুপুরে শুনতে পেলাম সেখানে কয়েকটি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা হয়েছে। এটা শুনে আমরা সেখানে কর্মচারীদের যেতে বলি। কর্মচারীরা সেখানে গিয়ে কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে বলে জানান। তবে রাতের আঁধারে কে বা কারা সেটি করেছে আমরা জানি না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //