আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস

দেশে ক্যান্সার রোগী ১৫ লাখ, বছরে মৃত্যু লাখের বেশি

গ্লোবাল ক্যান্সার ইনসিডেন্স, মর্টালিটি অ্যান্ড প্রিভিলেন্সের (গ্লোবোক্যান) পরিসংখ্যানের আলোকে ডব্লিউএইচওর অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) তথ্য মতে, বাংলা দেশে প্রতি বছর এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, আর প্রতি বছর মারা যান এক লাখ ৯ হাজার মানুষ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আক্রান্তদের সিংহভাগ চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান বিদেশে। আর যাদের দেশের বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের মধ্যে বেশিরভাগ আক্রান্তদের প্রাণ দিতে হয় পূর্ণ চিকিৎসা প্রাপ্তি ছাড়াই। কেননা দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের সুচিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। এমন অবস্থায় আজ শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস।

চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৮ লাখ মানুষ। আর প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হয় এক লাখ ৮০ থেকে দুই লাখ মানুষ এবং মৃত্যু হয় প্রায় ৫০ হাজার রোগীর। যেহেতু দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল এবং জাতীয় পর্যায়ে কোনো ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নেই। তাই বছরে সারাদেশে কত রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন এমন হিসাব সরকারের নেই।

আইএআরসির তথ্য মতে, দেশে পুরুষদের মধ্যে খাদ্যনালীর ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি। মোট পুরুষ রোগীর ১৬ শতাংশ এ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ ছাড়া পুরুষ আক্রান্তদের ১১ শতাংশ ফুসফুস। তবে নারীদের মধ্যে ১৯ শতাংশই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে ১২ শতাংশ।

দেশের একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। গত ডিসেম্বরে হাসপাতালটির ক্যান্সার রোগতত্ত্ব (ক্যান্সার এপিডেমিওলজি) বিভাগের প্রকাশিত ‘ক্যান্সার রেজিস্ট্রি রিপোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে মোট ৮৩ হাজারের কিছু বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ৩৫ হাজার। হাসপাতালটিতে ২০১৮ সালের পুরো বছরে পৌনে ১২ হাজার ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০১৯ সালে সাড়ে ১২ হাজারের কিছু বেশি ক্যান্সার রোগীর মধ্যে রয়েছেন সর্বোচ্চসংখ্যক গৃহিণী। এ হার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। একইভাবে ২০২০ সালে সোয়া ১১ হাজার ক্যান্সার রোগীর মধ্যে গৃহিণীর হার ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশে সাধারণভাবে পুরুষের চেয়ে নারী ক্যান্সার রোগীর হার বেশি। এই তিন বছরেও জাতীয় এই হাসপাতালটিতে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির মধ্যে নারীর হার ছিল ৫৫ শতাংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে অকেজো ১১টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রের মধ্যে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালেই রয়েছে ছয়টি। এছাড়া ঢাকা মেডিকেলে দুটি, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রংপুর মেডিকেলে একটি করে যন্ত্র অকেজো রয়েছে।

বিএসএমএমইউর অনকোলজি বিভাগে ভর্তি নাইম হোসাইন। তিনি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্যান্সারে আক্রান্তের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি। তিনি বলেন, আমার আজ ৬টি কেমোথেরাপি শেষ হয়েছে। একবার কেমোর জন্য আমার ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়।

তিনি বলেন, আরও দামি কেমোথেরাপি আছে কিন্তু এই চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ২০ লাখ খরচ হয়েছে। জমিজমা যা ছিল সব শেষ।

আরেক রোগী আনোয়ার হোসেন, ডেল্টা হাসপাতালসহ দেশের কত জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু কোথাও ক্যান্সার ধরা পড়েনি। তাতে আমার ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ চিকিৎসকরা আমাকে বলেছেন শুরুতেই ক্যান্সার ধরা পড়লে আমার অবস্থা এত জটিল হতো না।

বিএসএমএমইউর ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, দেশে ক্যান্সারসহ অসংক্রামক রোগগুলো ভয়াবহভাবে বাড়তে শুরু করেছে। শরীরের যেকোনো ক্ষত না শুকালে, অস্বাভাবিক রক্তপাত হলে, মূত্র বা মলত্যাগের অস্বাভাবিকতা, স্তনের গঠনের পরিবর্তন, গিলতে অসুবিধা, ক্রমান্বয়ে ওজন হ্রাস ও ক্ষুধামন্দা, গলায় কর্কশ শব্দ, কাশি, অকারণ ক্লান্তি, প্রায়ই জ্বর জ্বর অনুভূত ইত্যাদি সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত রোগের কারণ নিশ্চিত হতে হবে।

তিনি বলেন, দেশে ক্যান্সার শনাক্তের আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। তবুও ক্যান্সারের জটিলতায় প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করছে অগণিত রোগী। এর মূল কারণ আমাদের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, যেমন- সুপারি-জর্দা চিবানো, তামাক ও অ্যালকোহলের ব্যবহার। 

অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, ক্যান্সারের মাত্রা ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসা দিয়েও অনেক সময় ভালো ফল আসে না, অথচ শুরুতে এর সফলতা প্রায় শতভাগ।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, দেশে ক্যান্সারের সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। রোগী যাতে না বাড়ে সে জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ প্রাথমিক প্রতিরোধের মাধ্যমে তিন ভাগের এক ভাগ ক্যান্সার ঠেকানো যায়। নয় থেকে চৌদ্দ বছরের মেয়েদের একটা ভ্যাকসিন আছে। সেটা দিতে পারলে মেয়ের জরায়ু ক্যান্সার অনেক কমে যায়। বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় যে অতিরিক্ত খরচ নেওয়া হচ্ছে তা কমানোরও দাবি করেন এই বিশেষজ্ঞ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //