আত্মকর্মসংস্থানে অর্থ সংকট প্রকট

কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। একদিকে সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় চাকরির সুযোগ হচ্ছে না, অন্যদিকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে। উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে ওঠার অন্যতম ১০টি চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থের সংকট।

বৈশ্বিক ও জাতীয় নানা সংকটের কারণে ঋণের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ আরও কঠিন ও জটিল হয়েছে। অর্থের এই সংকট অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতেই সবচেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সংকটের কারণেই এই অর্থ সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটের সমাধান না হলে ভবিষ্যতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। 

বাংলাাদেশের ব্যবসার পরিবেশ কেমন সেটি যাচাইয়ে যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। ব্যবসা শুরু, জমির প্রাপ্যতা, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রমনীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সুবিধা, কর পরিশোধ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ঋণের প্রাপ্যতা- এই ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি করা হয়েছে।

১০টি সূচকের উপর ভিত্তি করে সার্বিক পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ৯৫, আগের বছর যা ছিল ৬১ দশমিক ০১ পয়েন্ট। ব্যবসায়িক পরিবেশ সূচকে খুবই সামান্য উন্নতি হয়েছে। ওই দশটি সূচকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ঋণ প্রাপ্যতা। এই সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৫ দশমিক ২২ পয়েন্ট। আগের বছর এই পয়েন্ট ছিল ৫০ দশমিক ৭৮। সাম্প্রতিক বছরে ব্যাংক ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। 

কোনো সূচকের স্কোর যদি ০ থেকে ৪০-এর মধ্যে থাকে, তার মানে হলো দেশে ব্যবসার পরিবেশ খুবই কঠিন। ঋণপ্রাপ্যতা সূচকে স্কোর ৩৫ দশমিক ২২। ২০২১ সালে এটি ছিল ৫০ দশমিক ৭৮। জরিপে ৮৭ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ ও অর্থায়ন পেতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের কথা জানান।

ওই জরিপে অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, ২০২০ সালে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকেই ব্যবসায় ঋণ প্রাপ্তি কঠিন হতে থাকে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র  ও মাঝারি ব্যবসার জন্য ঋণ পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য হয়েছে। কাগজপত্রসহ বিভিন্ন আইনি জটিলতা সৃষ্টি করেছে ব্যাংকগুলো। 

জরিপের ফল তুলে ধরে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ব্যবসার জন্য ঋণপ্রাপ্যতায় গত বছর বেশ অবনতি হয়েছে। খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার মতো অর্থ নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড়দের তুলনায় ছোটদের ঋণ দেওয়ার আগ্রহ দেখায় না ব্যাংকগুলো। সংস্কার কর্মসূচি ছাড়া এই জায়গায় উন্নতির সুযোগ কম।

বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অর্থায়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। নতুন উদ্যোক্তা ও নারীদের ক্ষেত্রে আরও কঠিন। নতুনদের জামানতের বিষয়টি সামনে এনে ঋণ প্রক্রিয়া আটকে দেওয়া হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এমএসএমই খাতের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের জামানত দাবি করেন।

ঋণের তুলনায় ২৭০ শতাংশ বেশি মূল্যের সম্পদ জামানত চাওয়া হয়। ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে চাহিদার তুলনায় অর্থের ঘাটতি হচ্ছে ২৮০ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রয়োজন সত্ত্বেও এই পরিমাণ অর্থ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও প্রবল। ৬০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা জামানতের অভাবে ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন না। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট জিডিপিতে ১ লাখ এসএমই উদ্যোগের অবদান ২৩ শতাংশ। মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে ৮০ শতাংশই এসএমই খাতে নিয়োজিত আর মোট জনশক্তির ২৫ শতাংশ কাজ করে এই খাতে। এই খাতের উদ্যোক্তারা চাহিদামাফিক ঋণ সুবিধা না পেলে সামষ্টিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

ঋণ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া, দলিলাদি, স্বীকৃত ব্যালেন্সশিট ইত্যাদি কারণে সিএমএস খাত বরাবরই ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ২০১৩ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, মাত্র ২৭ শতাংশ উদ্যোগ আনুষ্ঠানিক খাত থেকে ঋণ সুবিধা পেয়েছে। অন্যদিকে বড় শিল্প খাত পেয়েছে ৪৪ শতাংশ ঋণ সুবিধা। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও অর্থের সংকটও প্রকট। তবে এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। নিয়মনীতি না মেনে শুরুতে অনপযুক্ত খাতে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এই ঋণের টাকা নিয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও সরকারিভাবে প্রভাবশালীদের অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকেই বেনামে ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

এই ঋণগুলো এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এই খেলাপি ঋণই ব্যাংকগুলোর বোঝায় পরিণত হয়েছে। দেশে ব্যাংকগুলোতে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এই বিপুল অর্থ আটকে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারছে না। তবে ঋণ না পাওয়ার ক্ষেত্রে বড়দের তুলনায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন,  কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের উদ্যোক্তারা সিএমএসএমই সংজ্ঞায়নের জটিলতা, প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও এসএমই তথ্যভাণ্ডারের অভাব, ঋণ বিতরণ পদ্ধতির জটিলতা, উদ্যোক্তাদের ব্যাংক হিসাব না থাকা, ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের দুর্বলতা, জামানত নিয়ে সমস্যার কারণে ঋণ পান না। শিল্প খাতে ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাতে ৪৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে সিএমএসএমই খাত। তবে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও নীতিগত সহায়তার অভাবে সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সম্ভাবনা ও কর্মদক্ষতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না।

এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হলে আমাদের একটি বিকল্প সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। গতানুগতিক ব্যাংকিং ধারা অনুসরণ করে ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট রয়েছে। বৈশ্বিক কারণে এই সংকট যেমন সৃষ্টি হয়েছে তেমনি অভ্যন্তরীণ কিছু কারণ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর আটকে যাওয়া অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বেশকিছু তহবিল রয়েছে সেই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায় আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //