নবজাতকের মৃত্যুর তিন প্রধান কারণ

দেশে নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে প্রধানত ৩ কারণে। জন্মের সময় শ্বাসরুদ্ধ হওয়া, সংক্রামক রোগ (জীবাণুর বিষক্রিয়া) ও কম ওজন। ২০১৭-১৮ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, শিশু জন্মের ২৮ দিন পুরো হওয়ার আগেই বাংলাদেশে প্রতি এক হাজারের মধ্যে ৩০টির মৃত্যু হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর জন্ম নেওয়া ২৯ লাখ ২০ হাজার শিশুর মধ্যে গড়ে ৮৮ হাজারের বেশি নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে। নবজাতকের জীবন রক্ষার সুনির্দিষ্ট উপায় জানা সত্ত্বেও বছরে এতগুলো শিশু মৃত্যু দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। 

শিশুর জন্মগত শ্বাসরোধ অবস্থা

জন্মের সময় মায়ের শরীরে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে শিশুর মস্তিষ্ক এবং শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না। অক্সিজেনের ঘাটতি জন্মের সময় বা জন্মের ঠিক পরেও ঘটতে পারে। বাড়িতে জন্ম নিলে অদক্ষ দাইয়ের চোখে শিশুর অক্সিজেন ঘাটতিজনিত লক্ষণগুলো ধরা পড়ে না। ফলে শিশু জন্মগতভাবেই শ্বাসকষ্টে ভোগে। বিশিষ্ট নিউনেটোলজিস্ট ডা. ফারুকুল ইসলাম বলেন, জন্মগত শ্বাসকষ্টের কারণে শরীরের কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে পর্যাপ্ত কাজ করতে পারে না বলে শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমা হতে থাকে। যার ফলে কোষ বা কিছু অঙ্গের অস্থায়ী অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। প্রিম্যাচিউর ডেলিভারির (অকালে জন্ম) ক্ষেত্রে শিশুর শ্বাসকষ্ট বেশি দেখা যায়। চিকিৎসার পর অথবা এমনিতেই শিশুর স্বাভাবিক রক্ত​​প্রবাহ এবং অক্সিজেন কাজ করতে শুরু করলেও শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমা হয়ে টক্সিসিটি বেড়ে যায় এবং কোষের ক্ষতি হতে থাকে। 

জন্মগত হালকা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত শিশুদের সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া হলে কোনো জটিলতা ছাড়াই শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। দীর্ঘ সময়ের জন্য অক্সিজেন বঞ্চিত শিশুদের স্থায়ীভাবে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি এবং লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশু বেঁচে গেলে পরে ওই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হয় না। মানসিক অস্বাভাবিকতার দিকে যেতে পারে শিশু। কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের কারণে শিশুর দৃষ্টিশক্তিও বিঘ্নিত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে খিঁচুনিও হতে পারে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে শিশুর মধ্যে রক্তাল্পতাহেতু লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা অত্যন্ত কম থাকে। প্রত্যাশিত সময় থেকে অনেক আগেই জরায়ু থেকে প্ল্যাসেন্টা সরে গেলে, দীর্ঘায়িত ডেলিভারি, প্রসবের সময় বা জন্মের ঠিক পরে মা বা শিশুর মধ্যে সংক্রমণ, মায়ের হাইপারটেনশন, জন্মের সময় শিশুর শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে গেলে শিশু স্বাভাবিকভাবে বাতাসে শ্বাস নিতে পারে না, ফলে শিশুর জন্মগত শ্বাসকষ্ট হয়। 

শ্বাসরোধ প্রতিরোধের উপায় থাকলেও সে উপায় প্রয়োগ হয় না। ২০১৭ সালের বিডিএইচএস জরিপ বলছে, প্রায় ৮০ ভাগ সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ নবজাতকের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চর্চা নেই। অথচ জন্মকালীন শিশুর শ্বাসরোধ মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশের মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সর্বস্তরের সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ ব্যাগ ও মুখোশ সরবরাহ করেছে। নিরাপদ প্রসবসেবা, নবজাতকের শ্বাসরোধ দূর করতে ‘হেলপিং বেবিস ব্রেদ’ কর্মসূচি, নাভি বা নাড়ি পরিচর্যার ওষুধ সরবরাহ, কম ওজনের নবজাতকের জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারের মতো কার্যক্রম চললেও এগুলো খুব বেশি কাজ করছে না। বাড়িতে যে প্রসবগুলো হচ্ছে এর ৯৪ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর (দাই) হাতে। এ ক্ষেত্রে জটিলতা এবং মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি বেশি। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্ম নেওয়া শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ আবার জন্ম নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি ক্লিনিকে প্রসব মানেই অস্ত্রোপচার। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর জটিলতা দেখা দিলেই তারা বড় হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু রাস্তাতেই শিশুর মৃত্যু ঘটে।

কম ওজনের শিশু

দেশে মোট জন্মের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মে থাকে। বিশ্বের ১০ দেশে সবচেয়ে কম ওজন নিয়ে নবজাতকের জন্ম বেশি। কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ। তালিকার শীর্ষে থাকা ১০টি দেশই দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার। ১৬ মে, ২০১৯ তারিখে ‘দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ’ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ল্যানসেট বলছে, জন্মের সময় নবজাতকের গ্রহণযোগ্য ওজন আড়াই কিলোগ্রাম। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২৭ ভাগ অর্থাৎ ৮ লাখ ৬৪ হাজার শিশু জন্ম নিয়েছে আড়াই কিলোগ্রামের কম ওজনের। ২০০০ সালে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে ৩৬ শতাংশ শিশু। 

ওজন কম নিয়ে জন্মায় বলে এদের শরীরে তাপ কম, ফলে শক্তিও কম থাকে। মায়ের বুকের দুধ টেনে খাওয়ার শক্তি কম বলে এসব নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। এই শিশুদের বাঁচানোর জন্য কিছু হাসপাতালে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) নামের সেবা চালু করেছে। কিন্তু সচেনতার অভাবে মা অথবা অভিভাবকের এই সেবার প্রতি যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। কারণ ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে মাকেই সারাক্ষণ শিশুর যত্ন নিতে হয়। ওষুধ ও চিকিৎসকের ভ‚মিকা কম থাকে বলে মা অথবা অভিভাবক মনে করেন তার শিশু বাচ্চার প্রতি অবহেলা হচ্ছে এবং যেখানে ওষুধ ও চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায় সেখানে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা তাদের থাকে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে নবজাতককে বিশেষ ধরনের থলেতে পুরে মায়ের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রাখতে হয়, যেন নবজাতক একই সঙ্গে মায়ের বুকের উত্তাপ ও দুধ পায়। 

নবজাতক মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ অকালে জন্ম

একজন নবজাতক ৪০ সপ্তাহ (২৮০ দিন) মায়ের গর্ভে থাকার পর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু মায়ের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় কখনো কখনো সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হয়ে যায়। ৩৭ সপ্তাহ বা ২৫৯ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্ম নেওয়া এসব শিশুকে বলা হয় প্রিম্যাচিউর (অপরিপক্ব) নবজাতক বা অকাল জন্ম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, নিউমোনিয়ার পর বিশ্বে নবজাতক-মৃত্যুর বড় একটি কারণ এই অপরিক্ব শিশু জন্ম। মোট জন্মের প্রায় ৪৫ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু ঘটে সময়ের আগে জন্ম নেওয়ার কারণে।

সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৫০ লাখ নবজাতক ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে একটি প্রিম্যাচিউর শিশু জন্মায়। বিডিএইচএস ২০১৭-২০১৮ অনুযায়ী, জন্মের দুই থেকে ৭ দিন এবং ৮ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ১৮ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু হয়। প্রতিবছর ৯০ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হয়। ঘণ্টায় মারা যায় ১০ থেকে ১১ জন নবজাতক। শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, গর্ভবতী মা কিছু জটিলতায় ভোগেন, এসব জটিলতার কারণেই প্রিম্যাচিউর নবজাতকের জন্ম। মায়ের গর্ভকালীন অবহেলা, সময়মতো চিকিৎসা না করা এবং প্রসবের আগে কমপক্ষে ৪ বার ডাক্তার দেখিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে প্রসবের জটিলতা দেখা দেয়।

সেপসিসে শিশু মৃত্যু

মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত কাজ করলে সেপসিস নামক রোগটি হয়। এই রোগে প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে শরীরের অন্যান্য অঙ্গকেও আক্রান্ত করে। এক পর্যায়ে মানুষের অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। যেসব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগ হয়ে থাকে সেগুলোই সেপসিস হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। সেপসিস যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে, তবে অল্প বয়স্ক শিশু, বিশেষ করে অকালে জন্ম নেওয়া শিশু এবং নবজাতকদের বেশি আক্রান্ত করে। 

সেপসিস ফুসফুস, মূত্রনালি, ত্বক এবং অন্ত্রের সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত। সেপসিস সংক্রমণ সাধারণত গর্ভাবস্থায় মায়ের স্ট্রেপ্টোকক্কাল সংক্রমণ হলে, প্রসবের সময় মায়ের খুব জ্বর হলে, শিশুর অকাল জন্ম হলে অথবা মায়ের গর্ভের তরল প্রসবের ২৪ ঘণ্টারও বেশি আগে ফেটে গেলে রোগটি হতে পারে। শিশুদের সময়মতো প্রয়োজনীয় টিকা নেওয়া না হলে সেপসিস হতে পারে। শিশুদের জার্মান হাম (রুবেলা), চিকেনপক্স এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি হলে সেপসিস হতে পারে- বলেছেন বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //