কৃষিপ্রতিবেশ বিজ্ঞান

ভাষা, বৈচিত্র্য ও সম্পর্ক

আমরা যখন বৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলি, বিশেষ করে, বাংলাদেশ নিয়ে, তখন সেটি আমাদের গর্ব, মহিমা ও পরিচয়ের বিষয়। আমাদের বহুভাষার ময়দানের বিষয়। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ হলেও, বৈচিত্র্য-বৈভবে অনন্য। আমরা প্রাকৃতিক কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কথা বলতে পারি। পৃথিবীর এক ছোট্ট দেশ; কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এদেশে অবস্থিত।

আমাদের এই ছোট দেশেই রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, কিংবা বাংলাদেশই চামচ ঠুঁটো বাটান পাখি, ইরাবতী ডলফিন, নরম খোলের কালো কচ্ছপের প্রধান বিচরণস্থল। বাংলাদেশে প্রায় বিশ হাজার জাতের ধান ছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের দাবি এখন প্রায় আট হাজার জাতের ধান তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। আমাদের সমতল কী পাহাড়ে কৃষকদের মধ্যে এখনো অনেক জাত সংরক্ষিত আছে। 

বাংলাদেশ গভীর জলের ধানের (ডিপ ওয়াটার রাইস ভ্যারাইটি) আঁতুড়ঘর। এখানে সবচেয়ে বেশি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের গভীর পানির ধান পাওয়া যায়। ১৯৩৪ সনে হবিগঞ্জের নাগুড়াতে পৃথিবীর প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ বেগুনের আদি জন্মভূমি, যেটিকে কোনো একটি শস্য ফসলের জাতের ক্ষেত্রে ‘সেন্টার অব অরিজিন’ বলা হয়। বর্তমানের জামালপুর জেলার চৈতন্য নার্সারিতে বেগুন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান গবেষণা শুরু হয়। 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, এখানকার বাস্তুসংস্থানের বৈচিত্র্য (ইকোসিস্টেম ডাইভারসিটি) অনেক বেশি। আমরা দেখি কোন এলাকায় চরে কাশবন, কোন এলাকার উপকূলে উপকূলীয় বন, কক্সবাজার-চকরিয়াতে গর্জন মাতৃবৃক্ষের অরণ্য আছে, আমাদের বিভিন্ন রকমের শালবন আছে। ভাওয়াল-মধুপুরে এক রকমের শালবন, আবার দিনাজপুরে সিংড়ার শালবন অন্য রকমের। আমাদের সিলেট, পার্বত্য অঞ্চলে মিশ্র পাহাড়ি বন আছে।

সিলেটের লাউয়াছড়া, রেমাকালেঙ্গা, সাতছড়িতে বর্ষা-অরণ্য বা বৃষ্টি বন আছে। আমাদের অনেক গ্রামে গ্রামীণ বন আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনেক আদিবাসী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশ্বাস ও প্রথার মাধ্যমে পবিত্র বন সংরক্ষণ করেন। এই যে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য তার পাশাপাশি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও অনন্য। বাংলাদেশে ষাটের অধিক মাতৃভাষা আছে।

চাকমা, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, পাংখোয়া, মারমা, তঞ্চংগ্যা, রাখাইন, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, সাঁওতাল, ওরাও, লালেং, কোল, কডা, কড়া, খাড়িয়া, পাহাড়িয়া, বেদিয়া মাহাতো, খাসি, মান্দি, হাজং, মৈতৈ মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, জৈন্তিয়া, লেঙাম, কোচ, ডালু, বানাই, মুন্ডা, গৌড় এরকম বিরাট যে জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে তাদের যে জীবনযাপন, তাদের যে কৃষিপদ্ধতি, তাদের যে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, সেটি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি ও দলিল হয়তো সেগুলোর স্বীকৃতি দেয়নি; কিন্তু বাংলাদেশের পরিচয় ও বিকাশে এই বৈচিত্র্য খুব গুরুত্ব বহন করে। 

এই প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলোর বিবেচনা করাটা কৃষিপ্রতিবেশ বিজ্ঞান (অ্যাগ্রোইকোলজি) চিন্তার একটা প্রধান জায়গা। কোন একটি এলাকায় প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক যে বৈচিত্র্য, সেখানে মানুষ যেভাবে বসবাস করে, যেখানে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক, সেখানে প্রবীণের সঙ্গে সমাজের যে সম্পর্ক, শিশুদের সঙ্গে যে সম্পর্ক, ওইখানে যে দলিত জনগোষ্ঠী কিংবা ভিন্ন ভিন্ন পেশাজীবী আছে, তাদের ভিন্ন চর্চা, সেসব চর্চার স্বীকৃতিসহ যে কৃষি ব্যবস্থায়, যে খাদ্য ব্যবস্থায় আমরা সকলকে যুক্ত করতে পারে, সেটি আমাদের কৃষি-প্রতিবেশের ধারণাকে অনেক বেশি মজবুত করে। 

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক বাংলাদেশের উপকূলে সুন্দরবনের কাছের একটি গ্রাম। এখানে প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় হয়, এখানেই আমরা সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, ফণী দেখেছি এবং করোনাকালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দেখেছি। এই এলাকায় লবণাক্ততা মানুষের জীবনের জন্য একটা বড় রকমের সমস্যা। এই এলাকায় একসময় লবণ পানির ধান অনেক বেশি ছিল।

করচামুড়ি, বড়ান, পাটনাই, কুটেপাটনাই, নারিকেলমুচি, সাদামোটা, লালমোটা, নোনাখচি, জটাইবালাম, বুড়োমন্তেশ্বর এগুলো লবণ পানিতে টিকতে পারে এবং কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণাও আছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জেনেটিকে রিসোর্স শাখার মাধ্যমে উপকূলের ধানের জার্ম-প্লাজম নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে, সেখানে প্রমাণ মিলেছে যে, নোনাখচি, জটাইবালাম, দাদখানি এসব জাত অনেকখানি লবণ পানির জাত। 

ষাটের দশকে জনগণের সম্মতি ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেখানে নদীর সঙ্গে জমির সম্পর্ক, খালের সম্পর্ক, জোয়ার-ভাটার প্রবাহকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সকল কৃষি জমি এখন আবারো চিংড়ি ঘেরে পরিণত হচ্ছে, তার পাশাপাশি বছর বছর ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে, মানুষ তখন কৃষিতে থাকতে পারছে না, মানুষ তখন অন্য পেশায় দিনমজুর হচ্ছে, তারা ইটভাটায় চলে যাচ্ছে।

যে সমস্যা আমরা সকলে ভোগ করছি। আমাদের আশপাশের পুরুষরা ইটভাটায় চলে যাচ্ছে। আসলে আমরা স্থানীয় সমাজ ও জীবনধারাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং সেখানকার কৃষি বাস্তুসংস্থানকে বিবেচনা করে কোনো কৃষি পরিকল্পনা করিনি। আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছি, সেটা বলে দিচ্ছে যে, কোন একটি বিপর্যয়, কোন একটি দুর্যোগ, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো যে সংকট সেগুলো মোকাবেলা করার মতো আমাদের এখন এলাকা উপযোগী জলবায়ু সহনশীল জাতগুলো দরকার। 

দেখা যায়, সরকারি গবেবষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় কিছু গবেষণা করছেন; কিন্তু তারা কৃষকদের তাদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করছেন না। কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, তাদের লোকায়ত জ্ঞানকে সম্মান দিয়ে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। নোনাখচি, জটাইবালাম, দাদখানি, বুড়োমন্তেশ্বরের মতো জাতগুলো, যেগুলো কৃষকের জাত, সেগুলোর মাধ্যমে লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের কোন গবেষণা করতে চাইলে সেখানে কৃষকের যে জ্ঞান, প্রাণসম্পদের ওপর তার যে মালিকানা, তার যে অধিকার, সেসব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সেটি প্রতিষ্ঠা করে একসঙ্গে কাজ করা যায়। সেখানে কৃষকসমাজ, গ্রামীণ যুব সম্প্রদায়, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম একত্রেই এরকম কাজ করতে পারেন। 

আমরা যে বিভিন্ন কৃষি জমি দেখি; যেমন- উঁচু জমি, মাঝারি উঁচু, মাঝারি, একটু নিচু, একদম নিচু জমি বা বিল জমি, হাওরের কান্দা জমি, বাঁওড়ের নিচু জমি এই রকমের একেকটি জমিতে একেকটি ফসলের বিন্যাস থাকে। বিভিন্ন ধরনের ধান আছে- কোনোটি একটু উঁচু জমিতে, কোনোটি একটু নিচু জমিতে, কোনোটি মাঝারি উঁচু জমিতে হয়। কিংবা আমাদের বসতবাড়ির বাগানে উদ্ভিদের বৈচিত্র্য সেগুলোও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়।

আমরা যখন কোন একটি জায়গায় কাজ করব, তখন সেখানে জমির ধরন কেমন, ওই ধরনের জমিতে কী ধরনের ফসলের বিন্যাস হলে ভালো হয়, কোন মৌসুমে কী ধরনের ফসল ভালো হয় সেটা জানা জরুরি। এই যে আমাদের বিভিন্ন ধরনের গাছ আছে, তার বিভিন্ন অংশ যেমন- শেকড়, ডালপালা, পাতা, ফুল, ফল, বীজ হয়। সেগুলো মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো; যেমন, মানুষের হাত-পা, চোখ, কান, নাক, মুখ আছে।

মাটি আর সূর্যের আলো থেকে গাছ যে খাবার বানায় সেই পুষ্টি মাটির বিভিন্ন অংশ থেকে আসে। পাতার জন্য এক রকম পুষ্টি দরকার, আবার ফলের জন্য, ফুলের জন্য, বীজের জন্য, কাণ্ডের জন্য, শেকড়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রকমের পুষ্টি দরকার। আমরা জমির ধরণ বুঝে ফসলের বিন্যাস করব। সব মাটিতে সব ধরনের ফসল হয় না। জমিকে, মাটিকে বিবেচনা না করে আমরা সিনথেটিক সার সমানে মাটিতে ঢেলেছি। রোগ-বালাই রোধে সমানে বিপজ্জনক বিষ দিয়ে জোর করে ফসল ফলাতে গেলে, আমাদের কোনো উপকার হবে না।

আমরা হয়তো কিছু শাক-সবজি, ফসল পেলাম; কিন্তু আমাদের মাটি মারা গেল। এরকম জমি তার পরিচয় বা বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারে না। মাটি এক জীবন্ত বাস্তুসংস্থান। এখানে অণুজীব, কেঁচো, পতঙ্গ, ক্ষুদ্র উদ্ভিদ, ঘুমিয়ে থাকা বীজদানাসহ কত কী থাকে। সিনথেটিক সার ও বিষ দিয়ে এই মাটি হত্যা করে কৃষি উৎপাদন ‘কৃষিপ্রতিবেশ বিজ্ঞান’ সমর্থন করে না। 

কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল হিসেবে কৃষি জমির ভাগটা হয়ে থাকে। এক এক অঞ্চলে একেক রকমের জমি। চরের জমি একরকম, বিলের জমি একরকম, বরেন্দ্র অঞ্চলের জমি একরকম, উপকূলের জমি একরকম, পাহাড়ের জমি একরকম, টিলাভূমি একরকম আবার গড় অঞ্চলের জমি একরকম। বাংলাদেশের বিভিন্ন রকমের জমি, ভিন্ন মাটির ধরণ ও নদী অববাহিকা, এগুলো মিলিয়ে বলা হচ্ছে কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল।

কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশকে প্রধান ৩০টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ৩০টি অঞ্চলের ফসলের বিন্যাস ও চাষের ধরণও ভিন্ন ভিন্ন রকমের। বাংলাদেশে অবস্থিত ২৩০টি নদীর হিসেবে বাংলাদেশকে ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল রিজিওনে (পানি অঞ্চল) ভাগ করা হয়েছে। এই ভিন্ন ভিন্ন নদী অববাহিকার প্রতিবেশ, বাস্তুসংস্থান ভিন্ন ভিন্ন রকমের, সেখানকার মানুষের কৃষি সংস্কৃতি ভিন্ন রকমের হয়। এসব বিবেচনায় রেখেই আমরা একটি কৃষি চর্চাকে গ্রহণ করতে পারি, কিংবা এগিয়ে নিতে পারি। 

কৃষি কাজ নারীর হাত দিয়ে পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হলেও আমরা দেখছি কৃষিতে নারীর স্বীকৃতি নেই বা কৃষক হিসেবে নারীকে দেখা হয় না। যদি ‘কৃষকের’ ছবি আঁকতে বলা হয় তবে অধিকাংশই একজন পুরুষের ছবি আঁকবে। কখনো নারীর ছবি আঁকা হয় না। সমাজে বিদ্যমান বঞ্চনা, বৈষম্য এর একটা বড় কারণ। কিন্তু নারীর কৃষিতে যে কাজ, বীজ সংরক্ষণ থেকে জাত বাছাই, মাড়াই, বীজ বোনা, ফসল ফলানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্য পরিবেশন, ইত্যাদি সামগ্রিক যে খাদ্য ব্যবস্থা সেখানে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীরাই কোনো না কোনোভাবে সামাল দিচ্ছেন; কিন্তু তারপরও গ্রামীণ নারী কৃষিতে অনেক বেশি অদৃশ্য ও বঞ্চিত।

জমিতে নারীর মালিকানা প্রশ্নে বিতর্ক আছে, প্রাণসম্পদে তার মালিকানা নেই; কিন্তু যখন বীজের কথা বলা হয়, তখন অধিকাংশ সময়েই নিশ্চুপ থাকা হয়। বীজেও নারীর কোনো অধিকার বা স্বীকৃতি নেই। গ্রামীণ নারীরা ঐতিহাসিকভাবে ঘরেই বীজকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি ১৯৯৫ সন থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে আমি দেখেছি কীভাবে গ্রামীণ নারীরা বীজ সংরক্ষণ করেন। বীজ নিয়ে আমি যত যা শিখেছি তা গ্রামীণ নারীর কাছ থেকেই।

শিশি, বোতল, রাও, ধামা, ঝুড়ি, কলস, ডুলি’র মতো বিভিন্ন পাত্রে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ফসলের বীজ রাখা হতো; কিন্তু এখন নারীর বীজভাণ্ড শূন্য হয়ে গেছে। এটি বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের বীজনীতি, কৃষিনীতি আর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এই বীজশূন্যতা সৃষ্টিতে সহযোগিতা করেছে। 

আমরা কখনোই কোনো কৃষিউন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেটে জোরদারভাবে চাইনি নারীর বীজভাণ্ড নারীর হেফাজতে থাকুক। ঘরে ঘরে নারীর গ্রামীণ বীজাগারগুলি আরো বেশি সমৃদ্ধ হোক। আমরা চাইনি নারী বীজ রক্ষা করুক। সেটা চাইলে কী হতো? নারীর হাতে শস্যফসলের বীজের মজুদ থাকলে একটা বংশ রক্ষা হয়, একটা গ্রাম রক্ষা হয়, একটা পরিবার রক্ষা হয় এবং কৃষিকাজ রক্ষা হয়।

এখন এত দাম দিয়ে প্যাকেটের বীজ কিনতে হয় সেটি করতে হতো না, যদি বীজটা আমরা আমাদের ঘরে রাখতে পারতাম। উফশী, হাইব্রিড এসব বীজ নিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব বিবাদ আর হয়রানির ঘটনা ঘটছে। গ্রামে গ্রামে ঘরের ভেতর নারীরা যখন নিজেরা বীজ সংরক্ষণ করতেন তখন তো কোথাও এমন কোনো বীজ প্রতারণার ঘটনা ঘটেনি। যখনই বীজের দখল নিল বহুজাতিক কোম্পানি তখনি তারা কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করল।

২০১০ সনে সিনজেনটা কোম্পানির হাইব্রিড সবল টমেটো বীজ কিনে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ প্রতারিত হয়েছে, সেটা নিয়ে মামলা হয়েছে। সেটি নিয়ে জাতীয় সংসদে তৎকালীন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দুইবার বিষয়টি উত্থাপন করেছেন, তারপরও সিনজেনটার বিচার করা যায়নি। সিনজেনটা, মনস্যান্টো, বায়ার, কারগিল, বিএএসএফ এইসব বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ এত উচ্চ পর্যায়ে, এত জায়গায় আছে যে, এটি খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। আমাদের অনেক কিছু, যেমন, কৃষি, গবেষণা, গণমাধ্যম, এরকম অনেক কিছু বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 

কৃষিতে নারীর স্বীকৃতির কথা আমরা বলছি। নারীর কৃষিজ্ঞান খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এখন জাতিসংঘ থেকে শুরু করে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, বিশ্ব কৃষি সংস্থা, গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবাই স্বীকার করছে যে, নারীর কৃষিজ্ঞানটা কত গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা গর্বিত যে, আমাদের বিজ্ঞানী ও দার্শনিক খনা আমাদের জন্য প্রচুর বচন রেখে গেছেন। সেগুলো তিনি কৃষি নিয়ে দিয়েছেন, জলবায়ু, আবহাওয়া বিজ্ঞান নিয়ে দিয়েছেন, জীবনযাত্রা নিয়ে দিয়েছেন। যেমন, খনার বচনে আছে, ‘ফাল্গুনে আট, চৈত্রে আট, সেই তিল দায়ে কাট। ’ মানে, খনা বলেছেন, ফাল্গুন বা চৈত্র মাসের আট তারিখের মধ্যে তিল কাটতে হয়। কিংবা খনা বলছেন, কোনো মাসে পাঁচটি শনিবার বা পাঁচটি রোববার যদি থাকে, তাহলে সেই মাসে ঝড়বৃষ্টি হতে পারে, কিংবা অনাবৃষ্টি হতে পারে। অথবা, তার গুরুত্বপূর্ণ বচন, “ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন, শিগগির হবে বৃষ্টি যেন।” তার মতে, ব্যাঙ বৃষ্টিপাতের নির্দেশক। যদি বৃষ্টিপাত হতে হয়, তাহলে ব্যাঙের ডাক জরুরি; কিন্তু এখন আমরা কী দেখছি?

তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পরে আমরা কী ধরনের কৃষি চালু রেখেছি? এখানে ব্যাঙ থাকার পরিবেশই নেই, কোনো পরিস্থিতিও নেই। এখন জমিতে যে পরিমাণে বিষ দেওয়া হয়, তাতে সব পোকা-মাকড় মরে যায়। একটা ব্যাঙ পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে, অথচ এখানে ব্যাঙের কোনো খাবার নেই। আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে ব্যাঙ ধরে ইউরোপে রফতানি করা হয়েছে। এটা কৃষকরা করেনি, বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ করেনি।

এখানে রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ব্যাঙের পা রফতানি করবে। যখন বাংলাদেশে আর কোন ব্যাঙ নেই, তখন ওই রফতানি বন্ধ হয়েছে। যদি ব্যাঙ থাকতো, ব্যাঙ পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকত, তাহলে কৃষকের প্রতি মাসে এই রাসায়নিক বিষের পেছনে কোন টাকা খরচ হতো না। আমাদের মাটি, পানি ও জনস্বাস্থ্য বিপদে পড়তো না। 

নারীর কৃষি জ্ঞান এই কারণে জরুরি যে, নারীরা জানেন, কোন ফসলের জাত কীভাবে বাছাই করতে হয়, কীভাবে বীজ রাখতে হয়। কোনো কোনো বিশেষ চর্চা বা একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, যেমন খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, বৃষ্টি সেটা নারী জানেন যে কীভাবে সকল আপদ-বিপদ সামলে কৃষিচর্চা করতে হয়।

যখন চর এলাকা কিংবা নদী উপকূল কিংবা সমুদ্র উপকূল কিংবা হাওরে বন্যা আসে, কিংবা কোন পাহাড়ি ঢল বা ঘুর্ণিঝড় আসে, এরকম কোন একটা দুর্যোগের আগে একটা আগাম প্রস্তুতি আছে, যেটি পূর্বপ্রস্তুতি। আবার দুর্যোগ চলাকালীন সময় এবং দুর্যোগের পরেও কিছু প্রস্তুতি আছে। এসব বিশেষ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে নারীদের বিশেষ জ্ঞান আছে। যেমন, প্রস্তুতি হিসেবে আগে থেকেই অনেক ধরনের শুকনা খাবার, বীজ, গুরুত্বপূর্ণ দলিল বিভিন্নভাবে একটা জায়গায় মজুদ করা। 

বাংলাদেশে বিভিন্ন দুর্যোগের সময়, যেমন ঘূর্ণিঝড়ে, আমরা অনেক চেষ্টা করেও সবাইকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিতে পারি না। উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার ফলে অনেক প্রাণ বাঁচে বটে; কিন্তু সেখানে অনেক প্রান্তিক নারী যেতে পারে না। অনেক প্রবীণ, প্রতিবন্ধী মানুষের যেতে খুব সমস্যা হয়; কিন্তু কেন গ্রামের নারীরা সবসময় ঘর গেরস্থালি ফেলে যেতে পারে না? গ্রামের নারীদের সাধারণত দুই-তিনটা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি থাকে।

একজন গরিব নারী তার গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি রেখে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চান না, কারণ তিনি ঐ গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিকে তার সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। তিনি তার কোন সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন না। সেগুলো মারা গেলে তার পরিবারের ক্ষতি হবে।

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের মিডিয়াতে বন্যার একটি আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বন্যার সময় কোনো এক নারী ভেলায় বা নৌকায় চড়ে তার ঘর-গৃহস্থালির কিছু জিনিসপত্র নিয়ে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে, কিংবা গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, একজন গ্রামের নারীর কাছে সংসার বলতে কী বুঝায়। তার সংসার বলতে কেবল মানুষ বোঝায় না; বরং তার হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল বা তার বীজ বুঝায়, তার গাছপালা বুঝায়। আর এটিকেই আমরা ‘প্রতিবেশ’ বলছি, মানে ইকোলজি।

এই যে গাছপালা, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, জমি, মাটি, নদী, খাল-বিল-হাওর, এই সবকিছু নিয়ে আমাদের সংসার, এবং এদের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটিই প্রতিবেশ। আমরা যে সংসারে থাকি, সেটি একটি বাস্তুসংস্থান। আমাদের গ্রামীণ নারীর যে জ্ঞান, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে তার মানিয়ে নেওয়ার যে ক্ষমতা, তার টিকে থাকার যে ক্ষমতা, সেটিকে কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করা খুব জরুরি। আর এ ধরনের কৃষিচর্চাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কৃষি প্রতিবেশ বিজ্ঞান সেই কথাই বলে। 

কৃষি প্রতিবেশ বিজ্ঞান বা আমরা যে অ্যাগ্রোইকোলজির কথা বলি সেটি নারীর এই জ্ঞানের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে। এটি জরুরি। বাংলাদেশ চাইছে একটা জেন্ডার বৈষম্যহীন সমাজ, নারী-পুরুষের একটা সমতার সমাজ। যদি না আমরা কৃষিতে, কৃষি ব্যবস্থায়, খাদ্য উৎপাদনে নারীর যে অধিকার, তার যে ভূমিকা সেটিকে স্বীকৃতি দিতে না পারলে, মর্যাদা দিতে না পারলে, এবং সেটির পক্ষে না দাঁড়াতে পারলে সেই সমাজ যেমন গড়া সম্ভব নয়, তেমনি কৃষি প্রতিবেশও সম্ভব নয়। 

আমরা যখন কৃষি প্রতিবেশ নিয়ে কথা বলি, তখন সেটি কেবল চাষাবাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তথা কৃষক সমাজের বিষয় নয়, বরং এটি সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ রয়েছে তাদের সবার প্রচেষ্টার একটা ব্যবস্থা, যেটি সামগ্রিকভাবে ওই অঞ্চলের খাদ্য ব্যবস্থাকে ঠিক রাখে। এই খাদ্য ব্যবস্থায় কেবল মানুষ নয়, বরং তার আশপাশের গাছপালা, জীবজন্তু, প্রাণিজগত, মাটি, পানি, সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সবার বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত জোগান দেয়।

আদি সমাজে যেমন ছিল, কৃষক শস্য-ফসল উৎপাদন করতেন, কুমারেরা মাটির জিনিস, তাঁতিরা তাঁতের জিনিস, কিংবা জেলেরা মাছ ধরতেন। তাদের মধ্যে একটা বিনিময় প্রথা ছিল যে, গামছা দিয়ে ধান নিতে পারতেন, গোয়ালা দই দিয়ে কামারের কাছে থেকে দা নিতে পারতেন। এই বিনিময় প্রথাটি পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, নিজেদের ভেতরে আন্তঃনির্ভরশীল যে সম্পর্ক, মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি অনেক বেশি বাড়ায়। 

এমন একটি কৃষিব্যবস্থা জরুরি, যে ব্যবস্থায় ধান রাখার জন্য মাটির মটকা দরকার, প্লাস্টিকের জিনিস নয়। বীজ রাখার জন্য দরকার বাঁশের তৈরি ডোল। তাহলে, এই ডোল যারা তৈরি করেন সেই মণিঋষি বা রবিদাস জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, আর তার পেশাও টিকে থাকছে, যেটি প্রকৃতিক সম্পদ নির্ভর একটি পেশা। যারা মাটির জিনিস তৈরি করছেন, আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারছি।

এভাবে সম্পদের ব্যবহার ও বিনিময়ের মাধ্যমে এই কৃষি ব্যবস্থা অনেক বেশি চাঙ্গা থাকছে। পাশাপাশি বাজার নির্ভর পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, এবং প্লাস্টিকের দূষণ থেকে দূরে থাকতে পারছি। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ যে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু তারপরও আমরা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিশাল পরিমাণে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। এই পলিথিন এবং প্লাস্টিক কোনোভাবেই মাটির সঙ্গে মিশে না, কারণ এটি পচে না। তাহলে আমরা এই বিপজ্জনক জিনিসগুলো ব্যবহার বাদ দিয়ে আমাদের মাটি, বাঁশ কিংবা বাঁশের জিনিস ব্যবহার করতে পারি। 

এই করোনা মহামারির সময়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হলো কোন ধরনের জিনিসে এবং পৃষ্ঠতলে সবচেয়ে বেশি সময় করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারে। দেখা গেছে যে, কোন প্লাস্টিকের কিংবা ধাতব তৈরি কোন জিনিসে এই ভাইরাস অনেক বেশি সময় ধরে টিকে থাকতে পারে। মাটি বা বাঁশের তৈরি জিনিসে এই ভাইরাস খুব কম সময়ে টিকে থাকতে পারে। প্রতিটি মহামারি যেমন কলেরা, গুটি বসন্ত, ফ্লু কিংবা প্লেগ মহামারিতে সমসাময়িক জীবনযাপনের ওপর প্রভাব ফেলে, যেমনটি করোনাকালেও পড়ছে।

প্রতিটি মহামারিতে মানুষ অনেক কিছু শিখেছে। এই করোনা মহামারি যত বেশি সমস্যাই তৈরি করুক, বেশ কিছু দিকে আমাদের চোখও খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে সারা পৃথিবীর মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, মানুষ এই প্রাণপ্রকৃতির ওপরে নির্বিচারে অত্যাচার করেছে, সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক সমাজের পক্ষে দাঁড়ায়নি, জমিতে বিষ ঢেলেছে এবং এমন একটি খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে যেটি সবার জন্য বিপজ্জনক।

এটি যেমন জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক, তেমনি পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক এবং প্রাণজগতের জন্যও বিপজ্জনক। এরকম উপলব্ধি করোনাকালে বারবার হচ্ছে। দেশে দেশে মানুষ পরিবেশ-প্রকৃতির যন্ত্রণা যেন টের পাচ্ছে। যখন পৃথিবী লকডাউন হয়ে আছে, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে আছে, তখন পৃথিবীতে কার্বন নির্গমণ অনেক কমেছে। ঐ সময়ে আমরা দেখেছি দূষিত নগরী হিসেবে শীর্ষে অবস্থিত ঢাকার বাতাসও অনেকখানি নির্মল হয়েছিল।

তার মানে হলো, আমাদের টিকে থাকার স্বার্থে এই উপলব্ধিগুলো খুব জরুরি যে, আমরা প্লাস্টিক কিংবা পলিথিন ব্যবহার করবো না। আমরা সিনথেটিক সার কী রাসায়নিক বিষ কী সংহারী বীজ ব্যবহার করবো না। আমাদেরকে জীববান্ধব লোকায়ত ব্যবস্থা খুঁজে নিতে হবে। আর সেটি গ্রামেই খুঁজতে হবে এবং সেটি যে পেশাজীবী জনগোষ্ঠী করেন, তাদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। যে চর্চাগুলো আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাকে নিরাপদ করে সেগুলোকে অনেক বেশি খুঁজতে হবে। সিনথেটিক সার বাদ দিয়ে আমরা যদি মাটিকে এমন অবস্থায় রাখি যাতে মাটি নিজেই পুষ্টি গ্রহণ করে।

মাটি আর্দ্র থাকলে, সেখানে হিউমাস থাকলে তাহলে মাটি বেশি পুষ্টি পাবে, তত বেশি পুষ্টি শস্যকে দিতে পারবে, এবং তত বেশি পুষ্টি আমরা পাব। এভাবেই আমাদের উৎপাদন বেশি কাঙ্ক্ষিত হবে, অনেক বেশি নিরাপদ হবে আমাদের জন্য। অন্যদিকে, আমরা যত বেশি সিনথেটিক সার ব্যবহার করবো, মাটি তত বেশি মরে যাবে, মাটির পুষ্টি কমে যাবে। অধিক সার-বিষ ঢাললে হয়তো বা কিছু শস্য আমরা পাবো, হয়তো সেগুলো পরিমাণে বেশি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমরা আমাদের জমি ও জলাভূমিকে মেরে ফেলছি। এদিকে আমাদেরকে মনোযোগ দিতে হবে, এবং সেটি করতে হলে বেশ কিছু চর্চা আমাদের বাড়াতে হবে। 

আমরা চারদিকে বর্জ্য দেখছি। প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থায় বর্জ্য বলে কিছু নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি। আমাদের খাবারের বাড়তি অংশ আমরা স্ত‚প করে কোথাও রেখে দিতে পারি, বা সেটি দিয়ে আমরা জৈব সার- গোবরসার কিংবা কেঁচো সার, জীবাণু সার বা তরল সার তৈরি করতে পারি। আমরা সেখান থেকে বালাইদমনের পদ্ধতিগুলোও খুঁজে নিতে পারি। এই যে ফসলের নানান রোগব্যাধি রয়েছে।

আমাদের বুঝতে হবে, কোন কোন পোকামাকড় আমাদের জন্য বিপজ্জনক, কোনগুলো ক্ষতি করছে, কোনগুলো আমাদের উপকার করছে। আমরা মাকড়সা মেরে ফেলতে পারি না। আমরা প্রজাপতি, ফড়িং, মৌমাছি মেরে ফেলতে পারি না; কিন্তু আজকে জমিতে ব্যাপকভাবে বিষ বা কীটনাশক দেওয়ার ফলে আমরা মৌমাছি হারিয়ে ফেলছি।

আমরা যতবেশি মৌমাছি, ফড়িং বা প্রজাপতি হারাবো আমরা আমাদের শস্য ফসল আর পাবো না। এই পোকামাকড়, মৌমাছিরা পরাগায়নের মাধ্যমে গাছে গাছে মিলনের ব্যবস্থা করে দেয়, এবং তারপরই গাছে গাছে ফুল এবং ফল হয়, যেগুলো আমরা শস্য হিসেবে পাই। 

আমরা যতবেশি মৌমাছিসহ এই প্রজাপতি, ফড়িং, মাকড়সা, কিংবা ব্যাঙ, কেঁচো, কাঁকড়া, শামুক, গুইসাপ এদেরকে মেরে ফেলব ততই বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। এখন যে তথাকথিত বাজারমুখী বাণিজ্যিক আধুনিক কৃষি কাজ চলছে যেখানে জমিতে সিনথেটিক সার দেওয়া হচ্ছে, হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে, বিষ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো আমাদের প্রাণিজগতকে মেরে ফেলছে। এটি প্রমাণিত। এটি কেবল 

কৃষকরাই বলছেন না, এটি বিজ্ঞানী, গবেষকরা বলছেন এবং মানুষ তার জীবন থেকে উপলব্ধি করছে। আমরা এখান থেকে যে খাবার পাচ্ছি সেটিও অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এটি কেবল শস্যের জন্য নয়। আমরা মাছ চাষ কিংবা পোলট্রি শিল্পের দিকে তাকালেও একই অবস্থা দেখবো। প্রমাণিত হয়েছে, পোলট্রি বা মাছকে যে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে সেটি বিপজ্জনক খাবার, এবং সেটি কোনোভাবেই জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়।

কারণ হলো, এর ফলে যে পরিমাণে সীসা দূষণ ঘটে সেটি খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে চলে যাচ্ছে, সীসা কিংবা ক্রোমিয়ামের মতো ধাতু মানুষের শরীরে চলে যাচ্ছে। এগুলো ক্যান্সারসহ জটিল রোগ আমাদের শরীরে বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

তার মানে, খাবারটা নিরাপদ করে উৎপাদন করাটা জরুরি। খাবারটাকে নিরাপদ করতে গেলে আমরা জমিতে বা মাছের জন্য কিংবা মুরগির জন্য আমরা যে খাবার দিব সেটিও নিরাপদ হতে হবে। শুধু মানুষের খাদ্যকে নিরাপদ করার মাধ্যমে খাদ্য ব্যবস্থাকে নিরাপদ করা বোঝায় না, বরং হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, সবার খাবারই নিরাপদ হতে হবে। যদি আমি হাঁস-মুরগি কিংবা গবাদি পশুকে বিপজ্জনক রাসায়নিক খাবার খাওয়াই, সীসা-ক্রোমিয়াম মেশানো খাবার খাওয়াই সেগুলো ঘুরে আবার মানুষের শরীরেই আসবে। এটি পরিবেশের স্বাস্থ্যকে নষ্ট করতে পারে, এবং অনেক বিপদ ডেকে আনতে পারে। 

পাশাপাশি এই খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুদকরণ কিংবা বাজারজাতকরণ ও পরিবেশনে লক্ষ্য রাখা উচিৎ, সেখানে আবার কোন ধরনের বিপজ্জনক রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে কিনা। বাংলাদেশে ফরমালিন নিয়ে মানুষের বিরোধিতা আছে যে, আমরা ফরমালিন মুক্ত খাবার চাই। সরকার খাবারে এই ফরমালিন মেশানো বন্ধে যথেষ্ট কাজ করেছে।

আমরা যদি ফরমালিন দেওয়া মাছ না খেতে চাই, কিংবা কার্বাইডে পাকানো আম বা কলা না খেতে চাই, আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে যে, আমাদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে, জমিতে বা বাগানে এটি কতটুকু নিরাপদ। দিনাজপুরে লিচু গাছে ব্যাপকহারে সিনজেনটার রিপকর্ড বিষ ব্যবহৃত হয়। প্রমাণিত হয়েছে যে, লিচুতে বিষ দেওয়ার পরে সেই লিচু যখন গাছ থেকে পড়েছে সেটি আশপাশের গরিব বাচ্চা খেয়ে মারা যাচ্ছে।

কোনো বছরে বিশজন, কোনো বছরে আঠারোজন, আবার কোনো বছরে আটাশজন বাচ্চা লিচু খেয়ে মারা যাচ্ছে। কাজেই, আমরা কেবল ফরমালিন, কার্বাইড কিংবা হরমোন ব্যবহার না করলেই ফসল নিরাপদ হয়ে যাচ্ছে না। জমিতে যদি সিনথেটিক সার ও বিষ দেওয়া হয় বা এই ফল উৎপাদনকে যদি বিষাক্ত করে তোলা হয়, সেটিও তাহলে জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। 

খাদ্য যখন প্রক্রিয়াজাত হয়ে যায়, অর্থাৎ একটি খাবার থেকে আরেকটি খাবার প্রস্তুত হয়, যেমন, মুরগির মাংস থেকে একটা চিকেন বল তৈরি করা হচ্ছে কিংবা একটা নাগেট তৈরি করা হচ্ছে, কিংবা কেউ পিৎজা বা বার্গার খেতে পারে যার মূল উপাদান গম বা ভুট্টা সেটি কতটুকু নিরাপদ সেটি ভাবতে হবে। আজকের প্রজন্মের বাচ্চাদেরকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে, মিথ্যা বিজ্ঞাপনের জালে আটকানো হচ্ছে, কেএফসি বা পিৎজা হাটের জায়ান্টরা আজকে এটি করছে, কিংবা মুভেনপিকের মতো আইসক্রিমের দোকানগুলোকে প্রশ্ন করা উচিত।

কোক-পেপসিতে সীসা আছে, এটি রাসায়নিক দূষণে দূষিত বলে ভারতের অনেক প্রদেশে প্রশ্ন উঠেছিল, নিষিদ্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশে যেমন প্রশ্ন উঠেছিল নেসলের ম্যাগি নুডলস নিয়ে, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছিল এতে সীসা আছে, কিংবা বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির গুড়া হলুদে সীসা আছে, যেটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফেরতও এসেছে। 

এভাবে খাদ্যপণ্য যখন প্রক্রিয়াজাত হয়ে গেছে, সেটিকে অন্যভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিংবা আমাদের প্লেটে চলে আসছে। সেটি কতটুকু নিরাপদ সে বিষয়ে ভাবনা জরুরি, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যদিও গবেষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসকরা বলছেন, বিশেষ করোনাকালে তারা বলছেন ফাস্ট ফুড এর অতিরিক্ত ব্যবহার যাতে নিষেধ করা হয়। ফাস্ট ফুড বিপজ্জনক খাদ্যরুচি। এটি যার মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিৎ। 

ফাস্ট ফুড শুধু আমার মুটিয়ে যাওয়া বা বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি করছে তা নয়, এই ফাস্টফুড তৈরির যে উপকরণগুলো আছে, যেমন, মুরগি সেটি নিরাপদ নয়, কিংবা বার্গারের রুটিটা যে ভুট্টা থেকে তৈরি করা হচ্ছে সেটিও নিরাপদ নয়, কিংবা নিরাপদ চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে সেটি করা হয়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে এসব বার্তা দেওয়াটা জরুরি যে, আমরা কী খেতে চাই, আমাদের খাদ্যরুচিটা আসলে কেমন। তাকে ফাস্ট ফুডের বিকল্প দিতে হলে আমাদের কিন্তু অসংখ্য খাবার আছে। আমরা ফাস্ট ফুডের বিপরীতে আমাদের ভাপা পিঠা, পাটি সাপটা, শিঙাড়া, আলুপুরি, ঝালমুড়ি, জিলাপি, মিষ্টি আছে। 

এদিক থেকে বাংলাদেশ ঐতিহ্য ধারণ করে। আমরা এসব খাবারকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারি। এসব খাবারের বিকাশে, বিপণনে, উদ্যোক্তা তৈরিতে একদম রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা সহযোগিতা করতে পারি, বাজেট বরাদ্দ হতে পারে, বিশেষ নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে এবং গণমাধ্যম এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন প্রজন্মকে বিপজ্জনক খাবার থেকে নিরাপদ খাবারের দিকে আনতে হলে তাদের কাছে তথ্যগুলো তুলে ধরা জরুরি, কেননা তাদের কাছে সচরাচর তথ্যগুলো থাকে না। কাজেই গণমাধ্যম কিংবা যারা এ নিয়ে কাজ করছেন তারা এটা তুলে ধরতে পারেন। 

আরেকটি বিষয় হলো এই খাদ্য ব্যবস্থায় আমাদের প্রধানত প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভরতার কথা মনে রাখতে হবে। এই পৃথিবীতে মানুষসহ উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ মিলে দেখা অদেখা যে ভুবন যার মধ্যে আমাদের সম্পর্ক ও বসবাস, আমাদের এক জনের সঙ্গে আরেক জনের যে আন্তঃনির্ভরতার সম্পর্ক তার বিচার করা, উপলব্ধি করা, বুকের গভীর থেকে বোঝাটা জরুরি, এবং সেটি বিশ্বাস করাটা জরুরি।

আজকে যদি আমি শুধু এটুকু বুঝি যে, প্রাণবৈচিত্র্য বলতে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বা কিছু প্রজাপতি বোঝায়, কিংবা মিঠাপানির কুমির বা ঘড়িয়ালকে, বা বিশাল বটগাছ বা ধান বোঝায়, আম বোঝায় তাহলে আমরা ভুল করছি। বিষয়টি তা নয়। প্রাণবৈচিত্র্য বলতে শামুক, ব্যাঙ, মাকড়সা, গাছপালা থেকে শুরু করে মানুষকেও বোঝায়। মানুষ প্রাণবৈচিত্র্যে অন্যান্য প্রজাতির মতো একটি প্রজাতি মাত্র। 

এই একটি চিন্তাই বদলে দিতে পারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ যদি কেবল মানুষ কেন্দ্রিক চিন্তা, কৃষি কিংবা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে পারে, এবং সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে, এটিকে ভেঙে দিতে পারে, এবং মানুষ যদি মনে করে খাদ্য কেবল মানুষের জন্য নয়, সেটি সবার জন্য। আমি একটি মানুষ, নিজের ধানের জন্য বিষ দিয়ে ব্যাঙ মেরে ফেলবো বা ব্যাঙের খাবার পোকাদের মেরে ফেলব বা শামুক মেরে ফেলব কিংবা মাটিকেই মেরে ফেলব, কিংবা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলব তা হতে পারে না। কারণ, প্রাণ প্রজাতির অনেকে যদি মরে যায় তাহলে অন্য প্রজাতির উপরে আঘাত বা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। 

খুবই সহজ কথা, মানুষ যদি এত বড়াই না করে, মানুষ যদি উপলব্ধি করে তার এত শ্রেষ্ঠত্ব খোঁজার কিছুই নেই, কারণ সে আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল। একটা গাছ তো নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে। সে কারো ওপর নির্ভর করছে না; কিন্তু মানুষ নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারছে না; সে গাছের ওপর, অন্য প্রাণির ওপর নির্ভর করছে। মানুষ এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল প্রাণী।

সবচেয়ে নির্ভরশীল প্রাণিকে একটু থামতে হবে, একটু বুঝতে হবে, অন্তত এই করোনা মহামারীতে বিশ্বব্যাপী যে সংকট তৈরি হয়েছে সেই উপলব্ধি মানুষের ভেতরে জাগানোটা জরুরি। সকল ধরন, শ্রেণি, পেশার মানুষের এটা বোঝা জরুরি যে, কৃষি বা খাদ্য ব্যবস্থা শুধু কৃষকের ব্যাপার নয়, শুধু কৃষকের বা উৎপাদকের প্রশ্ন নয়, এটি একইসঙ্গে ভোক্তা, ক্রেতা, পরিবেশনকারী সবার বিষয়। সকল ধরনের পেশাজীবী মানুষ যদি একসঙ্গে এখানে কাজ না করে তাহলে আমরা আমাদের প্রাণপ্রকৃতির সবার জন্য কাক্সিক্ষত খাবারের জায়গায় পৌঁছাতে পারবো না।

এই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য একটি স্বপ্ন, একটি ব্যবস্থা, একটি বিজ্ঞান, কিংবা একটা আন্দোলনের নাম হচ্ছে কৃষি প্রতিবেশ বিজ্ঞান বা অ্যাগ্রোইকোলজি। সবাইকে এই ব্যবস্থা, বিজ্ঞান বা আন্দোলনের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানাই যাতে আমরা এমন একটি কৃষি, খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি যেখানে ন্যায্যতা, স্বীকৃতি, মর্যাদা এবং সবার জন্য সার্বভৌম, স্বাধীনতা নিশ্চিত ও বিকশিত হয়। 

লেখক: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //