রোজায় আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কা

আগামীকাল ২৪ মার্চ পবিত্র রমজান শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে মজুদ ও সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও রমজান ঘিরে কিছু ব্যবসায়ী এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাড়িয়ে দিয়েছে নিত্যপণ্যের দাম। এতে চাল, চিনি, তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দামই ক্রেতার নাগালের বাইরে। রয়েছে নিত্যপণ্য পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির অভিযোগ। পণ্যে নকল-ভেজাল এবং পরিমাণে কম দেওয়ার প্রবণতাও আছে সমানতালে। এ পরিস্থিতিতে শঙ্কায় রয়েছেন ক্রেতা-ভোক্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও আসন্ন রমজানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া  নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিসিবি, ওএমএস ও ত্রাণ বিতরণের অনিয়ম। এতে জনরোষসহ ছিনতাই, রাহাজানি ও চুরি তৎপরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আমাদের গোয়েন্দারা মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। সেখানে এ ধরনের আশঙ্কার কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি আরও জোরালোভাবে খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সজাগ রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে যদি কোনো গোষ্ঠী দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা চালায় তা হলে পুলিশ তা কঠোর হাতে দমন করবে। পাশাপাশি আগাম প্রস্তুতি হিসেবেও পুলিশের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া রয়েছে। গোপনীয় হওয়ায় সেগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া রমজানে টিকিট কালোবাজারি, পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি, যাত্রী হয়রানি, চাঁদাবাজি, অজ্ঞান পার্টির তৎপরতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটতে পারে। এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণে সরকারকে জোর তৎপরতা চালাতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে।

বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পবিত্র রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদার তুলনায় ঢাকা মহানগর এলাকায় এমনিতেই এসবের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে লোডশেডিং হলে, গ্যাসের চাপ কম থাকলে এবং অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ঘাটতি থাকলে জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।

আসন্ন পবিত্র রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে কোনো মহল যাতে কোনো ধরনের ইস্যু তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সে জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ করে কেউ যেন বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। শিল্পাঞ্চল, বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেজন্য শিল্প পুলিশকে তৎপর থাকতে হবে। রমজানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যেন কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা না ঘটে সেজন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেন আইজিপি। তিনি ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি প্রতিরোধে নিয়মিত টহল জোরদার করারও নির্দেশনা প্রদান করেন।

আইজিপি আরও বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল রোধ এবং রাস্তার উভয় পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। তিনি এ লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হাইওয়ে পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

এদিকে আসন্ন রমজান মাসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ প্রত্যেক কমিশনার।

বাজার নিয়ন্ত্রণে চলবে অভিযান
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি মোকামগুলোয় অভিযান চলবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজার মনিটর করবে। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা করবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মূলত রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং তার অধীনস্থ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও কাজ শুরু করেছে।

ইতোমধ্যে সরকার এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা সহজ করেছে। বাজারে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাজার পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিংয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে সরকারের ১০টি সংস্থা মাঠে থাকবে এবং ১৫ পণ্যের দাম বেঁধে দিতে কমিটি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভর্তুকিমূল্যে পণ্য সরবরাহে মাঠে থাকবে টিসিবি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পণ্য হাতবদল পর্যায়ে যাতে মজুদ না হয় তা নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেজন্য দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তথ্য নিয়ে নজরদারির কাজটি করা হচ্ছে। আর বাজার মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে এবার নতুন পদক্ষেপ হলো, যে বাজারে পণ্যের দাম লাগামছাড়া থাকবে ওই বাজার কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজার কমিটি যেহেতু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেয়, তাই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে দরকার হলে কমিটির অনুমোদন বাতিলের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কারণ বাজার কমিটি সক্রিয় থাকলে ওই বাজারে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে মজুদ করা সম্ভব হবে না।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পণ্য আমদানিতে এলসি জটিলতায় পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে রমজান মাসে চাহিদা বাড়ে এমন সব পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তি থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের দামের সঙ্গে এ বছরের দাম যদি এক হয়, তারপরও ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হবে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের মতে, ডলারের দাম বেশি থাকা এবং ছোট ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে না পারায় আমদানিনির্ভর পণ্যের আমদানি কমে গেছে। ফলে বন্দরে ওসব পণ্যের সরবরাহ কম। এ কারণেও চলতি বছর রমজানে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে।

বিগত ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে ৪৬ হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি করা হয়েছিল। আর ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত একই সময়ে ৩১ হাজার মেট্রিক টনের বেশি খেজুর আমদানি করা হয়েছে। গতবারের তুলনায় ওই সময়ে পণ্যটি ৩১ শতাংশ কম আমদানি করা হয়েছে। তবে পণ্যের বাজারে কোনো ধরনের ঘাটতি নেই। কিন্তু বাজারে পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও ব্যবসায়ীরা যোগসাজশ করে পণ্যের দাম বাড়ায়। যার ফলে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে বাজার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //