‘স্যার’ না ডাকায় কেন এত বিপত্তি!

মাঠ প্রশাসনের এক কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না ডাকা নিয়ে প্রশাসনে ফের বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ না ডাকলে প্রশাসনের, বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। অথচ কর্মকর্তাদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। বরং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের সেবক।

তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলছেন, ‘স্যার’ বলার সংস্কৃতিটি ঔপনিবেশিক। প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এখনো সেই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেননি। মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কর্মকর্তাদের সেই চিন্তাধারা থেকে বের করতে সরকারের পদক্ষেপও নেই।

শিক্ষক ‘স্যার’ না বলায় ক্ষুব্ধ ডিসি, সমালোচনার ঝড়

‘স্যার’ না বলায় রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন ক্ষুব্ধ আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ তোলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। এ ঘটনার প্রতিবাদে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে পালন করতে বসে পড়েন।

ওই শিক্ষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি দাবি করেন, আলোচনা শেষে বের হওয়ার সময় ডিসিকে আপা সম্বোধন করতেই তিনি ক্ষুব্ধ হন। এরপর ওই শিক্ষক জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে প্রধান ফটকে এর প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচিতে বসেন। তার সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। আসেন অন্য শিক্ষকরাও। জেলা প্রশাসক এসে দুঃখ প্রকাশ করার পর অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন ওই শিক্ষক।

শিক্ষক ওমর ফারুকের অবস্থান কর্মসূচির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সমালোচনার ঝড় ওঠে। কর্মকর্তাদের মানসিকতা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকেন নেটিজেনরা। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে প্রশাসন।

সমাধান কোন পথে

সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক, প্রভু নয় চাকরিতে প্রবেশের সময় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে তা কর্মকর্তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে এবং প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা। 

দুপক্ষের জন্য সম্মানজনক একটি সম্বোধন নির্ধারণ কিংবা আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের নাম ধরে ডাকার সংস্কৃতি চালু করা যায় বলেও জানিয়েছেন তারা। 

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে। আমাদের এখানেও এই কালচার শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে।’

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘স্যার বলার কালচার শত শত বছর ধরে চলে আসছে। এটা আমাদের ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য। এটার লালন শুধু প্রশাসনেই নয়, সমাজের সবখানে।’

তিনি বলেন, ‘১৮ লাখ সরকারি কর্মচারী, তাদের যদি আমাদের কৃষক ভাই স্যার না বলেন তারা রাগান্বিত হন। কখনো কখনো ডিসি ইউএনওকে স্যার না বলায় তারা এমন একটা আচরণ করেন যেটা খবর হয়। আমাদের আসলে যেতে হবে এই বিষয়টার গভীরে, যেটা ঔপনিবেশিক কালচার থেকে এসেছে, যা আমরা খুব চমৎকারভাবে লালন করছি।’

‘স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের সংস্কৃতিতে এমন কিছু করিনি যার মাধ্যমে তারা (কর্মকর্তারা) ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। এই সংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে হলে সার্কুলার দিয়ে কোনো লাভ হবে না। যখন নতুন নিয়োগ হবে, ট্রেনিং হবেতখন তাদের মধ্যে এ বিষয়ে চিন্তাটা ঢুকিয়ে দিতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন বলেন, ‘পদবি ধরে কর্মকর্তাদের সম্বোধন করা যায়। পদের আগে মাননীয় বা সম্মানিত বলা যেতে পারে। এতে সম্মানজনকভাবে এর সমাধান হতে পারে। এমন একটা পথ বের করতে হবে, যাতে জনগণের সম্মান রক্ষা হয় এবং কর্মকর্তারাও যেন সন্তুষ্ট থাকেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধি ও মানুষের উপরে হতে পারে না। এই বোধটা আমরা ওনাদের (সরকারি কর্মকর্তা) মধ্যে জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছি।’

‘স্যার’ না ডাকায় যত বিপত্তি

চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামুন খানকে সাংবাদিক আশিক জামান ফোনে তথ্য নিতে গিয়ে ভাই বলায় তিনি ক্ষেপে যান। এসি ল্যান্ড সাংবাদিককে তথ্য না দিয়ে বলেন, ‘তার আগে বলেন আপনি এসি ল্যান্ডকে ভাই কেন বলছেন, আমি আপনার কেমন ভাই?’

স্যার ডাকলে তিনি খুশি কিনা ওই সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না না আপনার স্যার ডাকতে হবে না। কিন্তু কখনো ভাই ডাকবেন না। এটা ফরমাল কোনো ডেকোরাম না।’

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে গিয়ে কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলায় এক সাংবাদিকের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শাহাদাৎ হোসেনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও যুগান্তরের প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম।

২০২১ সালের ৪ অক্টোবর কুমিল্লার বুড়িচংয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাম্মৎ সাবিনা ইয়াছমিনকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন জামাল উদ্দিন (৪৫) নামের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। এতে রেগে গিয়ে ওই ব্যবসায়ীকে ‘মা’ ডাকতে বলেছেন ওই ইউএনও। ভুক্তভোগী জামাল উদ্দিন বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করলে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়।

ওই বছরের ৩০ মে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাশও একই আচরণ করেন। এক সাংবাদিক ‘স্যার’ না ডেকে ভাই বলে সম্বোধন করায় আপত্তি তোলেন তিনি। ওই সময় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ বলেন, ‘আপনাদের ভাই বলে ডাকার রেওয়াজ আর গেল না। আপনি জানেন এই চেয়ারে বসতে আমাদের কত কষ্ট করতে হয়েছে?’

২০২১ সালের ৮ জুলাই মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলায় ইউএনওর নির্দেশে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে সিংগাইর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।

এছাড়া ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত চিকিৎসককে ‘স্যার’ না ডেকে ‘দাদা’ বলে ডাকায় ব্রেন স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। চিকিৎসার অভাবে রোগী মারা গেছেন বলে দাবি স্বজনদের। ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর একটি সংবাদের তথ্য নেওয়ার সময় ‘স্যার’ না ডেকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় এক সাংবাদিকের উপর ক্ষেপে যান সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের ইউএনও শফি উল্লাহ।

২০১৯ সালের ১৫ মে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ‘ম্যাডাম’ না ডাকায় এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকারের বিরুদ্ধে এক মাছ ব্যবসায়ীকে লাথি মারার অভিযোগ ওঠে। এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মাছ ড্রেনে ফেলে দেন এই সরকারি কর্মকর্তা। ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যশোরের অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুস সোবহানকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি অফিস থেকে চার সাংবাদিককে বের করে দেন।

২০১৮ সালের ৮ মার্চ ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় চট্টগ্রামের একজন সংগঠক সাজ্জাত হোসেনের সঙ্গে তখনকার পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেলুল কাদের দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ ওঠে। সাজ্জাত পরে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগও দেন। 

২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি স্যার না বলায় খুলনা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মল্লিক সুধাংশুর সঙ্গে তেরখাদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিটন আলী অশালীন আচরণ করেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।

সবশেষে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে একটা ক্লিয়ার মেসেজ গেছে। আমি বলে দিয়েছি স্যার বা ম্যাডাম বলার কোনো বিধান নেই। আমাদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হলে কেউ যদি কিছু বলে, রাগ করার কিছু নেই। আমার কাজটা হচ্ছে আপনাকে সার্ভিস দেওয়া।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //