আমানত তুলে নেওয়ার কতটা ঝুঁকিতে দেশ

গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বড় ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। আমানত নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ১৮৫টি ব্যাংক। মার্কিন মুল্লুকের ব্যাংক বন্ধের খবর সচেতন সব নাগরিকের মুখে মুখে। বাংলাদেশে ব্যাংক বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি কতটা?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটেছে। আর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি নিত্যসঙ্গী। ক্রমাগত লোকসান করেও বছরের পর বছর টিকে আছে কয়েকটি ব্যাংক। এর কারণ বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে ব্যাংক টিকিয়ে রাখছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বন্ধ হতে না দেওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয় বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের। ব্যবসায় সফল না হলে যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে এটিই স্বাভাবিক। 

চলতি মাসের শুরুতে গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ায় বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। এর পর থেকে নিরাপত্তার সম্ভাব্য ঝুঁকিতে থাকা ছোট অন্য ব্যাংকগুলো থেকেও আমানত সরিয়ে নিচ্ছেন গ্রাহকেরা। এরপর বন্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সিগনেচার ব্যাংক। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ১৮৫টি ছোট ব্যাংকে আমানত রেকর্ড পরিমাণে কমেছে। 

আমানতকারীদের জমানো অর্থ ব্যাংকের ‘ব্লাড’। এই রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হলে ব্যাংক তার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর যদি ব্লাড বের হয়ে যায় তাহলে সেই ব্যাংক বন্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক। আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটেছে ২০১৭ সালে। উদ্যোক্তা ও শীর্ষ ম্যানেজমেন্টের দুর্নীতির কারণে অর্থ নয়-ছয় হওয়ার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় তৎকালীন দি ফারমার্স ব্যাংক থেকে সমুদয় অর্থ তুলে নেন আমানতকারীরা। জমানো অর্থ ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন গ্রাহকরা। 

তবে সেই সময় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে বন্ধ হতে দেয়নি। এটির নাম পরিবর্তন করা হয়। আগের দুর্নীতিবাজদের দৃশ্যত কোনো শাস্তি না দিয়ে ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা সরবরাহ করে গ্রাহকদের আমানত ফেরতের ব্যবস্থা করা হয়। আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।

পরিচালকদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) আমানতকারীরা জমানো অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। কয়েক বছর ধরে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পেতে আন্দোলন করছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত অর্থ ফেরত পাননি। বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ না করলে এগুলো এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। 

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিত থেকে একেবারেই ভিন্ন। কারণ দেশের অনেক ব্যাংকই দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির মধ্যে আছে। একটি আদর্শ পরিস্থিতিতে ক্রমাগত লোকসানে থাকা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে না। ব্যাংকও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে দুর্বল ব্যাংকগুলোকেও অবসায়ন করতে দেয় না। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো না। 

দুর্বল ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা সাধারণত দাবি করেন যে, কোনো ব্যাংক অবসায়ন হলে তা পুরো ব্যাংকিং খাতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। দুর্নীতি ঢাকার জন্য তারা এ ধরনের দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি একটি দুর্বল ব্যাংক কার্যক্রম চালিয়ে যায়, তাহলে তা সিস্টেমিক ফেইলিওর তৈরি করে। আমাদের উচিত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অবসায়ন করে দেওয়া। অবসায়নের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের বা পরিচালকদের নয়।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চললেও সমস্যার সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে 

প্রকৃতপক্ষে এই খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পেছনে মূল ভূমিকা অনিয়ম ও দুর্নীতি। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক, রাষ্ট্রের প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে ব্যাংক নানামুখী সংকটে পড়েছে। এই ধরনের কোনো কিছুই ছিল না আমেরিকান ব্যাংকে। শুধু গ্রাহকদের আস্থার কারণে দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়েছে। তবে বাংলাদেশেও গ্রাহকরা অনেকাংশে সচেতন হয়েছেন। 

সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা প্রকট হয়নি। আমানত কিছুটা কমলেও পরে তা আবার বেড়েছে। যেসব দুর্নীতির কারণে আমানতকারীদের আস্থায় চিড় ধরেছে সেসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ব্যাংকগুলোর তফাত অনেক। তাদের সংকট থেকে আমাদের সংকট ভিন্নতর। এখানে সংকটগুলো সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাণ্ড আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। ব্যাংকের দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //