প্রসবকালে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে বছরে ব্যয় ২৩৬৯ কোটি টাকা

প্রতি বছর বাংলাদেশে সন্তান প্রসবে বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার। ২০২২ সালে প্রসবকালে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে কমপক্ষে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ বাড়তি খরচের তথ্য পাওয়া যায়।

গত সপ্তাহে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) সবশেষ যে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে দেশে ৪৫ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। এ অস্ত্রোপচারের ৩০ শতাংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুয়ায়ী অপ্রয়োজনীয়। 

প্রসূতি রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশান আরা বেগম বলেছেন, প্রসবে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকপক্ষ যেমন দায়ী, তেমনি সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদেরও দায় রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রসব হয় এমন প্রতিটা হাসপাতালে লেবার রুম থাকতে হবে। অনৈতিক কাজ যেন না হয়, তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়াতে হবে। 

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বিশ্ব ব্যাংকসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের ২০১৮ সালের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গড়ে একটি প্রসবজনিত অস্ত্রোপচারে বাংলাদেশে খরচ হয় ২২ হাজার ৮৫ টাকা। জাতীয়ভাবে আর কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি বলে আগের খরচটিকে বর্তমান খরচ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। 

সবশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩৬ লাখ ৩ হাজার ৫০৬টি শিশুর জন্ম হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ১৬ লাখ ৯ হাজার ১৫৬টি শিশুর জন্ম হয়েছিল অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে ১০ লাখ ৭২ হাজার ৭৭০টি শিশুর জন্ম হয়েছিল অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে। 

অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার না হলে এসব শিশুর জন্ম হতো স্বাভাবিক প্রসবে। স্বাভাবিক প্রসবের কিছু হয় বাড়িতে, কিছু হাসপাতালে। আগের গবেষকেরা দেখেছেন, স্বাভাবিক প্রসবে গড়ে ৩ হাজার ৫৬৫ টাকা করে খরচ হয়।

স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে প্রতিটি প্রসবে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৮ হাজার ৫২০ টাকা করে। গত বছর শিশু জন্মে বাড়তি খরচ হয়েছে ১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। এই টাকায় ১৪ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের ৩ বছরের খরচ চালানো সম্ভব। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য বছরে বরাদ্দ থাকে ৬০০ কোটি টাকা।

প্রতিবেশী সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বা আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিসার (ওপিপি) বেশি। স্বাস্থ্য খাতে এখন যত ব্যয় হয়, তার ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ যায় ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে।

অন্যদিকে প্রসবে যত অস্ত্রোপচার হচ্ছে তার ১৪ শতাংশ হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে, এনজিও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হচ্ছে ২ শতাংশ। বাকি ৮৪ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতালের ৬৯ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রয়োজন ছাড়াই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, প্রসবে অস্ত্রোপচারের পুরো টাকাটা যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকের পকেটে। এটা ব্যক্তির ওপর বিরাট চাপ। সরকারের এখনই নজর দেওয়ার সময়। চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে গিয়ে দেশের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গর্ভধারণের জটিলতা দেখা দিতে পারে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মায়ের ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় মায়ের ও সন্তানের জীবন রক্ষার জন্য। অস্ত্রোপচার সন্তান প্রসবে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন নয়। তবে প্রতিটি অস্ত্রোপচার মায়ের এবং ক্ষেত্র বিশেষে নবজাতকের শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

অস্ত্রোপচারের কারণে মা ও সন্তানের ওপর কী বিরূপ প্রভাব পড়ে তার একটি তালিকা করেছে আমেরিকান প্রেগনেন্সি অ্যাসোসিয়েশন। তাতে বলা হয়েছে, অস্ত্রোপচারের কারণে মায়ের অস্ত্রোপচারের স্থানে ও জরায়ুতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, অস্ত্রোপচারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে, হাসপাতালে অবস্থানের সময় ও সুস্থ হয়ে ওঠার সময় দীর্ঘ হতে পারে, অনেকের ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

আমেরিকান প্রেগনেন্সি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, যদি যথাযথভাবে গর্ভধারণের তথ্য রাখা না হয় তাহলে অস্ত্রোপচারে অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে, এসব শিশুর ওজন কম হয়। কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। অন্তত শতকরা একভাগ শিশু অস্ত্রোপচারের সময় আহত হয়। 

স্বাভাবিক প্রসবের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রসবে অস্ত্রোপচার বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসবের সময় কেন অস্ত্রোপচার সুপারিশ করা হচ্ছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের তা সুস্পষ্ট করে বলতে হবে। স্বাভাবিক প্রসব ও ঝুঁকিগুলো তুলনা করতে হবে এবং সম্ভাব্য সেরা বিকল্প বেছে নিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য ও প্রসূতি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বন্ধে যেমন বৈশ্বিক উদ্যোগ রয়েছে তেমনি দেশের বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন। যতদ্রুত সম্ভব স্বাস্থ্য ও অর্থ রক্ষায় এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //