বঙ্গভবনে বরণ ও বিদায়ের সুর

ঈদের ছুটিতে সব সরকারি অফিস-আদালত যখন বন্ধ, তখন বেশ কয়েকটি সরকারি অফিসে কর্মচাঞ্চল্য, কর্মমুখর সবাই। বঙ্গভবন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না। এর অন্যতম কারণ আগামী সোমবার বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। আর বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বিদায়। 

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘসময় কোনো রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করেননি। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কমলাপুর গ্রামে জন্ম নিয়ে তিনি নিজের জন্মস্থান ও দেশকে উজ্জ্বল করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পড়াশোনা শেষ করে কিশোরগঞ্জ বারে অ্যাডভোকেট হিসেবে প্র্যাকটিস করেন। তিনি ৫ বার কিশোরগঞ্জ জেলার বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে সরাসরি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে ময়মনসিংহ ১৮ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে জয় লাভ করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালে ১৪ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়কার রাষ্টপতি জিল্লুর রহমান হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এই বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে ২২ এপিল বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি র্নিবাচিত হন। ২৪ এপিল শপথগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে ৭ ফ্রেব্রুয়ারি তিনি আবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দীর্ঘপথ পরিক্রমায় তিনি আগামী ২৪ এপ্রিল বিদায় নিতে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজনে বঙ্গভবনের দরবার হলে এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার কাজ চলছে। আজ-কালের মধ্যে বসবে সোফা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা দায়িত্ব বণ্টন করে যে যার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। শপথ অনুষ্ঠানে প্রায় ১ হাজার ২০০ অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এর মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী রয়েছেন। শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বেশ কয়েকটি উপকমিটি গঠন করেছে। 

এদিকে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই তার বিদায় অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন সেখানে সবার উদ্দেশে কিছু বক্তব্য দেবেন। বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে তিনি সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন। এরপর তিনি সবার কাছে বিদায় নেবেন। বঙ্গভবনের বহু স্মৃতি বহু কথা বুকে নিয়ে আগের প্রটোকলে ১০ বছর পর বঙ্গভবন ত্যাগ করবেন তিনি।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, তিনি বঙ্গভবন থেকে সরাসরি রাজধানীর নিকুঞ্জে তার নিজস্ব বাড়িতে গিয়ে উঠবেন। অনেক আগে থেকে এ বাড়িতে ডেকোরেশনের কাজ চলছে। নিজস্ব বাড়িতে নতুন করে বেশ কিছু আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। মো. আবদুল হামিদ নিকুঞ্জে বেশ কয়েক দিন থাকার পর নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন। 

দীর্ঘদিনের কর্মমুখর একজন রাজনীতিবিদ অফুরন্ত অবসর সময় কীভাবে কাটাবেন? আপনজনদের কাছে তিনি নিজেই খুব মন খুলে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি তাদের বলেছেন, আমি সবসময় মানুষের পাশে থাকব। মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি। ওদের ছেড়ে আর কোথাও যাব না। এতদিন আমি এক ধরনের বন্দিজীবন কাটিয়েছি। এখন আমি মুক্ত হচ্ছি। আমি নিকুঞ্জে কিছু দিন থেকে চলে যাব কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে। রাত পর্যন্ত ঘুরব, বেড়াব। চায়ের দোকানে আড্ডা দেব। আর লাল চা খাব। তিনি নিজেই তাদের কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। 

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বঙ্গভবনের কয়েকজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করতেন। আমাদের সঙ্গে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। সুখে-দুখে তিনি আমাদের সহায়তা করতেন। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন কর্মচারী কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, তিনি আমাদের একজন অভিভাবক ছিলেন। যেকোনো বিষয় নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া যেত। 

বঙ্গভবনের একজন বার্বুচি জানান, রাষ্ট্রপতি সকালে একটা রুটি, সবজি, দুটো ডিম খেতেন। মেহমানদের খাওয়াতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। দুপুরে তার খাবারের তালিকায় থাকত মাছ, সবজি, সালাদ আর সামান্য ভাত। 

বঙ্গভবনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পোশাকের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ছিলেন একেবারে সাদামাটা। ফুল শার্ট কিংবা কখনো হাফ শার্ট পরতেন। পোশাকের প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না। যখনই ঘুমাতেন না কেন, খুব ভোরে উঠতেন। বাগান কিংবা বারান্দায় পায়চারি করতেন। গাছ, পশুপাখি ছিল তার খুব প্রিয়। তিনি গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন। বিশেষ করে তার প্রিয় শিল্পী ছিল মান্নাদে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে মাঝেমধ্যে ভাটিয়ালি, লালনের গানও শুনতেন খুব মনোযোগ দিয়ে। আমরা ভাবতাম, উনি বঙ্গভবন ছেড়ে চলে যাবেন, হয়তো মনটা খারাপ। কিন্তু কোনোভাবেই বোঝার উপায় ছিল না, তিনি মন খারাপ করছেন। 

এদিকে নতুন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন আগামী ২৪ এপ্রিল সকালে তার গুলশানের নিজস্ব বাসা ছাড়ছেন। বাসা থেকে আপাতত কোনো আসবাবপত্র যাচ্ছে না। তবে বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতির জন্য বেশ কিছু আসবাবপত্র কেনা হয়েছে বলে বঙ্গভবন সূত্রে জানা গেছে। 

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে মুঠো ফোনে কথা বললে তিনি জানান, আগামী ২৪ এপ্রিল সকাল ১১টায় শপথ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। শপথের পর থেকেই তিনি বঙ্গভবনে অবস্থান করবেন। 

তার মানসিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে মানসিক অবস্থা ভালোই রয়েছে। রয়েছে সার্বিক প্রস্তুতি। তবে তিনি কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //