পুনর্নির্ধারণ হয়নি ১৭ খাতের ন্যূনতম মজুরি

৪৪টি শিল্প খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে থাকে সরকার। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ৫ বছর পর পর এ সব খাতের মজুরি পুনর্নির্ধারণের কথা রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ১৭ খাতের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়নি। এমনকি এর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় তিন যুগ পেরিয়ে গেলেও পুনর্নির্ধারণ করা যায়নি নিম্নতম মজুরি। এতে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মালিকদের অসহযোগিতার কারণে মূলত দীর্ঘদিনেও কোনো কোনো খাতের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা যায়নি। আবার বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দু-একটি খাতের প্রাসঙ্গিকতা এখন আর নেই, তাই বছরের পর বছর গেলেও মজুরি পুনর্নির্ধারণ হয়নি।

বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে বাজারমূল্য বিশ্লেষণ করে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সংশ্লিষ্ট খাতের মালিকরা এই মজুরির নিচে কোনো শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করতে পারেন না। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, অনেক সেক্টরেই সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি মানেন না মালিকরা। এ বিষয়ে সরকারের কোনো তদারকিও নেই।

ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দায়িত্ব নিম্নতম মজুরি বোর্ডের। বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র জেলা জজ লিয়াকত আলী মোল্লা। এছাড়া নিরপেক্ষ সদস্য হিসেবে রয়েছেন ড. মো. কামাল উদ্দীন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক ও কোষাধ্যক্ষ), মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য মকসুদ বেলাল সিদ্দিকী (বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের উপ-মহাসচিব) ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য সুলতান আহম্মদ (জাতীয় শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক)। এই কজন বোর্ডের স্থায়ী সদস্য।

যে খাতের মজুরি নির্ধারিত হয় সেই শিল্পের মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন সদস্য বোর্ডে যুক্ত হন। ন্যূনতম মজুরির মেয়াদ (৫ বছর পূর্ণ) শেষ হলে শ্রম অধিদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট খাতের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি নির্ধারণ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। মন্ত্রণালয় তখন বোর্ড গঠন করে গেজেট জারি করে। তখন নিম্নতম মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মজুরি বাড়ানোর বিষয় থাকে বলে মালিকরা সহজে প্রতিনিধি দিতেন না। আবার শ্রমিকদের মধ্যেও দলাদলির কারণে তারা অনেক সময় একমত হতে পারেন না। তাই সময়মতো মজুরি নির্ধারণ করা যায় না।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ৫ বছর পার হওয়া শিল্প সেক্টরের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধির নামের প্রস্তাব শ্রম অধিদপ্তর থেকে পাওয়া সাপেক্ষে মজুরি পুনর্নির্ধারণের কার্যক্রম শুরু হবে। মালিক প্রতিনিধির মনোনয়ন পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনকে, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির নামের প্রস্তাব প্রেরণের জন্য জাতীয় শ্রমিক লীগকে ফের তাগিদপত্র এবং বিভাগীয় শ্রম দপ্তর ও আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে তাগিদপত্র পাঠানো হয়েছে।

ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ৪৪ খাত

ন্যূনতম মজুরি বোর্ড টাইপ ফাউন্ড্রি, পেট্রল পাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, টি-গার্ডেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন, অয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, প্রিন্টিং প্রেস, রি-রোলিং মিলস, হোমিওপ্যাথ কারখানা, সল্ট ক্র্যাশিং, রাইস মিল, প্লাস্টিক, নির্মাণ ও কাঠ, কোল্ডস্টোরেজ এবং কৃষি ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক ব্যতীত বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করে।

এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল, রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, সিনেমা হল ও জুতা কারখানা, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ, জুট প্রেস অ্যান্ড বিলিং, স-মিলস, চিংড়ি, মৎস্য শিকারি ও ট্রলার, বিড়ি, বাংলাদেশের স্থলবন্দর, হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, হোসিয়ারি, সোপ অ্যান্ড কসমেটিক্স, ফার্মাসিউটিক্যাল, টি-প্যাকেটিং, জাহাজ ভাঙা, ট্যানারি, দর্জি কারখানা, কটন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, বেকারি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল, গার্মেন্টস, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেট এবং সিকিউরিটি সার্ভিস খাতের মজুরিও নির্ধারণের দায়িত্ব বোর্ডের হাতে। নতুন সেক্টর হিসেবে প্রথবারের মতো ‘সিমেন্ট কারখানা’ ও ‘সিরামিকস’ খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বোর্ড।  

সময় পার হলেও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয়নি যে ১৭ খাতের

৪৪টি খাতের মধ্যে টাইপ ফাউন্ড্রি খাতের ন্যূনতম মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৩ সালের ৭ আগস্ট। তখন ন্যূনতম মোট মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২১ টাকা। ৩৬ বছর পার হলে ন্যূনতম মজুরি আর বাড়েনি। পেট্রল পাম্প খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৭ সালের ৩০ নভেম্বর। তখন নির্ধারণ করা ৭৯২ টাকা ন্যূনতম মজুরি এখনো বহাল রয়েছে। এছাড়া ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর আয়ুর্বেদিক কারখানার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ১০ বছর পেরোলেও এখনো ন্যূনতম মজুরি ৪ হাজার ৩৫০ টাকাই আছে।

সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৪ জুলাই আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ২০১০ সালে টি-গার্ডেন, ২০১০ সালের ১ জুলাই অয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, ২০১১ সালের ১ মে সল্ট ক্র্যাশিং, ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর কোল্ড স্টোরেজ খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।

কৃষি ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক ব্যতীত বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করা হয় ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর।

২০১৩ সালের ২২ আগস্ট সিনেমা হল, ২০১৪ সালের ১৭ জুন জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয়।

এছাড়া ২০১৭ সালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, হোসিয়ারি, সোপ অ্যান্ড কসমেটিকস, ফার্মাসিউটিক্যাল ও টি প্যাকেটিং খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয়। ইতোমধ্যে এসব খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় ৫ বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে।

এছাড়া চলতি বছর জাহাজ ভাঙা; ট্যানারি; দর্জি কারখানা; কটন টেক্সটাইল, বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি; অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ; অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল এবং গার্মেন্টস খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় ৫ বছর পার হবে।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, ‘বিভিন্ন সেক্টরের ন্যূনতম মজুরি চূড়ান্ত করে সুপারিশ আকারে ইতোমধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনেকগুলোর খাতের মজুরি নির্ধারণের কাজ চলমান রয়েছে।’

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের এক সদস্য বলেন, কোন কোন খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় ৫ বছর পেরিয়ে গেছে, সেগুলোর তালিকা করা হয়েছে। মুশকিল হলো, মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি পাওয়া যায় না। মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি ছাড়া তো সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করতে পারে না। এজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেরি হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘টাইপ ফাউন্ড্রিসহ কিছু কিছু সেক্টর রয়েছে যেগুলোর সেভাবে অস্তিত্ব নেই। এসব খাত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //