বাজারে আগুন, বাড়ছে গ্যাসের দাম

আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে এক চুলার বিল ৩৮৯ টাকা বেড়ে হবে ১ হাজার ৩৭৯ টাকা এবং দুই চুলার বিল ৫১২ টাকা বেড়ে হবে ১ হাজার ৫৯২ টাকা। এর আগে গত জুনে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ায় জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি।

বাড়ানোর যুক্তি কী? সেই পুরনো কাসুন্দি-অপচয় রোধ করা, আয় বাড়ানো এবং সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখা!

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক দফায় বেড়ে এখন জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মানুষ দিশেহারা। সে সময় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য সেবার দাম বাড়ানো হচ্ছে। জানা কথা; গ্যাসের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের দামও বাড়বে, কারণ প্রায় ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ গ্যাস পুড়িয়ে উৎপাদিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ভাড়া বাড়বে। পরিবহন ভাড়া বাড়লে পণ্য মূল্য আরেক দফা বাড়বে। অর্থাৎ আজকে বাজারের যে আগুন, কালকেই তা দাবদাহ হতে যাচ্ছে।

আর সেই সময়ে সরকার জনগণের নাকের ডগায় ছুড়ে দিচ্ছে একের পর এক মুখরোচক ইস্যু! যেমন ছয়টি দেশের দূতাবাসের বিশেষ প্রটোকল অনুযায়ী বিশেষ নিরাপত্তা বাতিল। ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় পাই না’ ধরনের মন্তব্য। 

মোটা দাগে ভাবলে কী পাওয়া যাবে? এসব প্রতিষ্ঠানে সীমাহীন লুটপাটের কারণে লাভের বদলে লোকসান হচ্ছে। অথচ কেউ বলবে না-এদের তথাকথিত ‘সিস্টেম লস’ কমাতে পারে না কেন? শীর্ষ মহলের চুরি-ডাকাতির কাফফারা দেবে সাধারণ মানুষ। এটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর।

পেট্রোবাংলার ভাষ্য, টাকার অভাবে গ্যাসের আমদানি বিল মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। পেট্রোবাংলার দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এলএনজি আমদানি বাড়ানোর বিষয়ে চাপ আছে। কিন্তু টাকার অভাবে আমদানি করা যাচ্ছে না। জানুয়ারি মাসে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বিল জমা হয়েছে, তার অর্ধেক পরিশোধের মতো টাকা আছে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবে। এর বাইরে নতুন করে ১০টি এলএনজি কার্গো আমদানি করতে হলে ২৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। টাকা না পেলে আমদানি করার সুযোগ নেই।

অথচ ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে ১৭৪ শতাংশের বেশি। পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা।

সংশ্লিষ্ট মহল নয়, একজন সাধারণ মানুষও জানেন দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নজর না দিয়ে সরকার আমদানিতে গেছে। এর মাশুল এখন দিতে হচ্ছে এভাবে ঘন ঘন দাম বাড়িয়ে। গ্যাস খাতের অনিয়ম ও অপচয় কমিয়ে এবং সরকারি ভর্তুকি সমন্বয় করে দাম না বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। 

সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘শিল্পসহ সব গ্রাহক গ্যাসের খরায় ভুগছে। এর মধ্যে নতুন করে দাম বাড়ানোর কোনো নৈতিক অবস্থান নেই সরকারের। এটা গ্রাহকের কাছ থেকে লুণ্ঠনের শামিল, চরমতম প্রতারণা।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা?

সরকার গ্যাস আমদানির পথে হেঁটেছিল সংকট দেখিয়ে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির অবকাঠামোগত সক্ষমতা আছে। এটি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।

২০১৯ সালে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম ৩২ শতাংশের কিছু বেশি বাড়ানো হয়। কিন্তু পরে সরকার আমদানি ততটা করেনি। এ কারণে বাড়তি আদায় ৯ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে পেট্রোবাংলা সেই টাকা ফেরত দেয়নি।

২০২২ সালে আবারও দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। বিইআরসি গত জুনে ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। তখন আমদানি ধরা হয়েছিল দিনে ৬৮ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরকার পরের মাস জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয়। এতে এলএনজি সরবরাহ কমে যায়। সেটা একসময় দৈনিক ৩৮ কোটি ঘনফুটে নেমে যায়। এখন দিনে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৪২ কোটি ঘনফুট।

গ্যাসের অভাবে বিপাকে পড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ব্যবসায়ীদের আবার বলা হয়, গ্যাসের বাড়তি দাম দিলে আমদানি করা যাবে। ব্যবসায়ীরা এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। কারণ জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিলে তাদের প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ৯ টাকার বেশি। আর গ্যাস থেকে কারখানার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ব্যয় দাঁড়ায় ৪ টাকার কম। এ অবস্থায় বাড়তি দামে গ্যাস পাওয়া তাদের জন্য মন্দের ভালো। এর মধ্যে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে ডলার সংকট।

আইএমএফ বলেছে, ‘যেভাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ হিসাব করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। তারা যেভাবে হিসাব করতে বলেছে, সে অনুযায়ী দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে’। আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশে এখন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে যা থাকবে সেটাই নেট রিজার্ভ।

সেই হিসাবে দেশে নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। অথচ পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট বেরুচ্ছে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪৫০ কোটি ডলার। এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান মাধ্যম রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স। কিন্তু গত অক্টোবর মাসে এই দুই প্রধান খাতেই আয় কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে (জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি রয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার বা প্রায় তিন দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময় যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার তুলনায় ৩৬১ কোটি ডলারের পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে। 

কিন্তু সার্বিক বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময় বাংলাদেশ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স মিলিয়ে আয় করেছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলার, কিন্তু আমদানি ব্যয়, বিদেশে চলে যাওয়া অর্থ মিলে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার। কিন্তু যেভাবে বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়ে চলেছে, তাতে সেটি সহসা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।

৬ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমাদের যে রিজার্ভ আছে, সেটা দিয়ে অন্তত পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যদিও তিন মাসের আমদানি করার মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট।”

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা ব্যবহারযোগ্য ২৬ বিলিয়ন নেট রিজার্ভের সঙ্গে বিভিন্ন তহবিলে এবং ঋণ হিসাবে দেওয়া অংশ যোগ করলে মোট ৩৪ বিলিয়ন হবে। কিন্তু যেভাবে এক বছরের মধ্যে ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে কমতে কমতে সেটা এখন গ্রস ধরলে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়।”

এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। এরই মধ্যে সরকার গত ১০ মাসে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৮২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংক নোট ছাপিয়ে। এভাবে সম্পদের জোগানের বাইরে নোট ছপানো মানে মুদ্রাস্ফীতি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই মুদ্রাস্ফীতি-মুদ্রাসংকোচন বিষয়গুলো সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানে না। সে কারণে কেন বাজারে পণ্য থাকতেও হুহু করে দাম বাড়ে সেই হিসাব পায় না। 

সাধারণত ‘নির্বাচনের বছর’ আসলে সরকারের জনপ্রিয় থাকার জন্য জনহিতকর পদক্ষেপ না নিতে পারলেও অন্তত জনগণের সর্বনাশ হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেয় না, কিন্তু এখানকার সরকার জনগণের ভালো-মন্দ দেখার কোনো প্রয়োজনীয়তাও দেখছে না। আগামী কিছুদিনেই গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে বর্তমান অগ্নিমূল্যের বাজারের আগুন আরও কতটা বাড়বে সেটা অনুমান করতে ভয় হয়। কীভাবে বাঁচবে মানুষ?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //