সিক্যাফের গবেষণা

সাইবার স্পেসে বেড়েছে নতুন অপরাধ

সাধারণ মানুষের কষ্টের উপার্জন গায়েব করতে গ্রাহকের মোবাইলে আসছে বিশেষ ধরনের খুদেবার্তা। তাতে লেখা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার গেমিং অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা জিতেছেন। টাকার লোভে খুদেবার্তায় পাঠানো লিঙ্কে ক্লিক করলেই সর্বনাশ! অ্যাকাউন্ট থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে সব টাকা। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে প্রতারকদের কোনো ওটিপিরও প্রয়োজন নেই বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের প্রতারণার নাম দিয়েছেন ‘এপিকে ফ্রড’। প্রতারকদের পাঠানো লিঙ্কে ক্লিক করলে গ্রাহকদের অজান্তেই ফোনে ডাউনলোড হচ্ছে এপিকে ফাইল। মূলত সে ফাইলকে হাতিয়ার করেই টাকা গায়েব করছে প্রতারকরা।

সাইবার পরিসরে এমন সব নতুন ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে ৩৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সাইবার স্পেসের অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য তুলে ধরেছেন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিক্যাফ) গবেষকরা। এছাড়া সাইবার স্পেসে শিশু ভুক্তভোগীর হার ২০১৮ সালের থেকে ২০২৩ সালের এ কয়েক মাসেই বেড়েছে ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। 

ধারাবাহিকভাবে পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের সাইবার অপরাধপ্রবণতা নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিক্যাফ। এবারের প্রতিবেদনে সাইবার অপরাধকে গবেষকরা ১১টি ট্যাবে (ক্যাটাগরিতে) ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরিতে সবচেয়ে বেশি অপরাধ বেড়েছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস, ঋণ দেওয়া এবং অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা ইত্যাদি। গবেষকদের মতে, ২০২২ সালের প্রতিবেদনে যেখানে অন্যান্য ক্যাটাগরির অপরাধ ছিল ১ দশমিক ৮১ শতাংশ, চলতি বছরের প্রতিবেদনে এটি ৩৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

গবেষকদের তথ্যানুযায়ী, সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধও গত কয়েক বছরে বড়েছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে অনলাইন ও ফোনে বার্তা পাঠানো, পর্নোগ্রাফি, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার ও ছবি বিকৃতি। এ ধরনের অপরাধ ২০২২ সালে ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ রেকর্ড করা হয়, যা ২০১৭ সালে ছিল ৫১ দশমিক ১০ শতাংশ।

সাইবার স্পেসে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য আইডি হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে কমলেও আর্থিক সংশ্লিষ্ট প্রতারণা বাড়ছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২০২২ সালে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এছাড়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি হ্যাকিংয়ের প্রথম পৃষ্ঠার পর

শিকার সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশই নারী। এছাড়া গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতারণা বাড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অভিযোগের হার দিন দিন কমছে। ২০১৮ সালে জরিপে দেখা যায়, অভিযোগকারীর শতকরা হার ছিল ৬১ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশে। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনাক খান বলেন, ‘সাইবার পরিসরে অনেক মানুষ অপরাধের শিকার হলেও অভিযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যাচ্ছে না। মূলত নানারকম ভয় বা শঙ্কায় তারা পুলিশের কাছে যেতে চায় না। এছাড়া তাদের কাছ থেকে কতটুকু সহায়তা পাওয়া যায় এটাও জানার বিষয়।’ 

সিক্যাফের গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, ২০২৩ সালের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সাইবার স্পেসে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮-এর নিচে। এ সংখ্যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচারের শিকার হয় শিশুরা। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা কর্মকর্তা নাহিয়ান রেজা সাবরিয়েত বলেন, ‘যে উপাত্ত এ গষেণায় তুলে আনা হয়েছে তাতে দেখা যায়, সাইবার পরিসরে মানুষ কী ধরনের অপরাধের শিকার বা হয়রানি হচ্ছে। শিশুরাও সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে, তাই তাদের কেন্দ্রিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।’ 

সাইবার বিশেষজ্ঞরা জানান, আগের তুলনায় প্রতারণা ধাঁচেও বেশ কিছু বদল এনেছে প্রতারকরা। এমন গ্রাহকদেরকেই খুদেবার্তা পাঠানো হচ্ছে, যাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না। এপিকের মাধ্যমে যারা প্রতারণা করছে তাদের কাছে পৌঁছানোও কঠিন। তাদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। কেননা মোবাইলে পাঠানো লিঙ্কটি কয়েক ঘণ্টার জন্য সক্রিয় থাকে। সে কারণে পুলিশ লেনদেনের হদিস পায় না। গ্রাহকের অজান্তে ফোনে ওই এপিকে ফাইল ডাউনলোড হয়ে যাওয়ার পর এসএমএস ফরওয়ার্ডিং সফ্টওয়্যার ব্যবহার করছে প্রতারকরা। ফলে গ্রাহকের মোবাইলে কোনো ধরনের এসএমএস আসছে না। সেই কারণে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গায়েব হলেও গ্রাহকের কাছে কোনো ধরনের খুদেবার্তাও আসে না। 

প্রতারকরা এপিকের মাধ্যমে দূর থেকেই গ্রাহকের মোবাইলের যাবতীয় অ্যাক্সেস হাতে তুলে নেয়। জনপ্রিয় গেমিং ওয়েবসাইটের নাম করেই চলছে এ প্রতারণা। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উধাওয়ের পর সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারছেন না, কীভাবে তারা প্রতারণার শিকার হলেন। কারণ তারা কারও সঙ্গে ওটিপি-ই শেয়ার করেননি।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, ‘দেশে বিপুল পরিমাণ ডাটা ব্যবহার বেড়েছে গত কয়েক বছরে। ইন্টারনেট এখন আমাদের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপদে কাজ করার জন্য অনেকে অনলাইন স্পেসে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে ফিজিক্যালি যাওয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে চান। তবে এখানে সাইবার অপরাধীরা লোভ দেখিয়ে বিপদে ফেলছেন। অপরাধের জায়গাগুলোও প্রায় একই আছে কিন্তু সংখ্যা বেড়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘রেগুলেটর হিসেবে আমরা আইএসপি প্রোভাইডারদের জন্য কিছু পলিসি তৈরি করে দিয়েছি। সেটা না মানলে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তাছাড়া আমরা কল সেন্টার চালু করতে যাচ্ছি বিটিআরসির পক্ষ থেকে, যাতে মানুষ তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে এবং সমস্যার সঠিক সমাধান নিতে পারে। মূলত সবার সমস্যার কথা বিবেচনা করেই এটা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //