বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়াম

কৃষির উদ্বেগ নাকি সম্ভাবনা

প্রকৃতিতে যখন বিশেষ প্রাণ বা সত্তা নিয়ে আলোচনা তোলা হয়, তার সঙ্গে বিশেষ স্থান ও কালের বৈশিষ্ট্য জড়িয়ে থাকে। সে হিসেবে কোনো প্রাণ এককভাবে খারাপ বা ভালো নয়।

বরং বাস্তুসংস্থানে তার নিজস্ব গুণাগুণ ও অবস্থানের আলাদা মূল্য থাকে। কোনো একটি পরিসরে কোনো গুণ প্রকট হয়ে ওঠে। যদিও মানবকেন্দ্রিক এ বিশ্বে প্রকৃতিকে দেখা হয় মানুষের ভালো-মন্দের নিরিখে। আবার বিশেষ বিশেষভাবে দেখার কারণে সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে যায় চোখের আড়ালে। 

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রতি পার্থেনিয়াম নামের এক আগাছার বিস্তার ঘটেছে। দুই দশক আগেও যার অস্তিত্ব এদেশে ছিল না। প্রতিবেশী ভারত থেকে বছর কয়েক আগে এটি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এখন সীমান্তঘেঁষা অন্তত ৩৫টি জেলার ২৫ ধরনের ফসলের ক্ষেতে বিস্তার ঘটেছে উদ্বেগজনক এ আগাছার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পার্থেনিয়াম বেগুন, টমেটো, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের পরাগায়ণ কমিয়ে দেয়। ধান, ছোলা, সরিষা, গমসহ বিভিন্ন ফসলের অঙ্কুরোদ্গম ও বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ফলে পার্থেনিয়ামের বিস্তার খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি বলেও মনে করছেন তারা। আবার আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, পার্থেনিয়াম একটি সবুজ সার, কম্পোস্ট, জৈব নিয়ন্ত্রণ ও মাটির উন্নতি ঘটাতে পারে যা মাটির ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যকে উন্নত করতে পারে। 

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা জানান, পার্থেনিয়াম আসলে আগাছা Asteraceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি আক্রমণাত্মক ও এক বর্ষজীবী বীরুৎ উদ্ভিদ। উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চল, মেক্সিকো এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এর উৎপত্তি। এখন পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশ এবং অসংখ্য দ্বীপসহ বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত এ আগাছা। বাংলাদেশে এটি নাকফুল নামে পরিচিত। বছরে গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাত ৫০০ মিলিমিটারের ওপরে হলে এ আগাছা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি প্রশস্ত অভিযোজন, আলো এবং তাপ অসংবেদনশীল, খরা-সহনশীল, শক্তিশালী প্রতিযোগী ও অধিক বীজ উৎপাদনে সক্ষম, মাটির নিচে বীজের দীর্ঘায়ু, ছোট ও হালকা বীজ যা বহু দূরত্বে ভ্রমণে সক্ষম।

দেশের উদ্ভিদবিদরা বলছেন, যশোরে ২০০৮ সালে প্রথম পার্থেনিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। প্রথম দিকে রাস্তার দুই পাশেই কেবল এ উদ্ভিদের উপস্থিতি চোখে পড়ত। পরে তা পতিত জমি, এমনকি ফসলের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে। এখন বিভিন্ন দানা জাতীয় ফসল, ডাল ও তেল ফসল, সবজি, মসলা জাতীয় ফসল, কন্দ জাতীয় ফসল, এমনকি ফল বাগানেও পার্থেনিয়াম নিজের অস্তিত্ব গেড়েছে। বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; রংপুর বিভাগের রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট; খুলনা বিভাগের যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর প্রভৃতি জেলার রাস্তার পাশে ও ফসলের ক্ষেতে এ আগাছার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি এ পরগাছা দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এলাকায়।

জানা গেছে, পার্থেনিয়াম সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে আমের বাগান, আখ, কলা, হলুদ ক্ষেতে। এছাড়া উচ্চমাত্রার আক্রমণ হয় করলা, শিমসহ বিভিন্ন ক্ষেতে। মটর, শিম, আদা ও করলা ক্ষেতে দেখা যায় মাঝারি মাত্রার আক্রমণ। আলু, টমেটো ও গম ক্ষেতে এ আগাছা দেখা গেলেও তুলনামূলক কম। কিছু কিছু জেলায় বিক্ষিপ্তভাবেও ফসলের ক্ষতি করছে এ আগাছা। তবে সামগ্রিকভাবে অধিকাংশ জেলায় পতিত জমিতে পার্থেনিয়ামের উপস্থিতি ব্যাপক পাওয়া গেছে। সারা বছরই এটি জন্মায়। তবে গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ পরগাছা অ্যালিলোপ্যাথিক যৌগগুলোর মাধ্যমে বেগুন, টমেটো, মরিচ ইত্যাদির পরাগায়ণ হ্রাস করে। গম, ভুট্টা, মরিচ, শিম, টমেটো ও বেগুনের ফল ও দানা গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া ও মরিচের বীজের অঙ্কুরোদ্গম ও বৃদ্ধি কমিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। 

দেশে পার্থেনিয়াম আগ্রাসনের তথ্য অনুসন্ধানে ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ৩৫টি জেলায় জরিপ চালিয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন, বিএল নাগ, অধ্যাপক রেজাউল করিম, এমএইচ রহমান ও এম মাসুম। তাতে দেখা গেছে, বিষাক্ত আগাছাটি ভারতের সীমান্তবর্তী বৃহত্তর যশোর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেই বেশি। কত ধরনের ফসলের ক্ষতি করছে এবং এটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি কিনা, সেটি খতিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। পরে ২০১৯ সালের দিকে ভারতীয় একটি কৃষিবিজ্ঞান সাময়িকীতে এ গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ফসল উৎপাদন হ্রাস করে দেওয়ায় পার্থেনিয়াম এখন দেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক আগাছা।

গবেষক দলের সদস্য বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘পার্থেনিয়ামের তথ্য অনুসন্ধানে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আসেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ অ্যাডকিনস। তার সঙ্গে ছিলেন দেশের একদল কৃষি বিজ্ঞানী। তারা ওই সময় যশোর অঞ্চলে আগাছাটির উপস্থিতি শনাক্ত করেন।’ 

তিনি বলেন, ‘রাস্তার ধারে, পতিত জমি, তৃণভূমি এবং বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে এর সবচেয়ে ঘন উপদ্রব পাওয়া গেছে। আমরা শুধু একটি প্রজাতির পার্থেনিয়াম শনাক্ত করেছি। এটি দেশে উৎপাদিত অনেক ফসলকে প্রভাবিত করেছে।’ 

গবেষণার তথ্য বলছে, রাজশাহীর চারঘাট ও পুঠিয়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় হলুদ, আদা, কলা, দেশীয় শিম, আমের বাগান ও মটর ক্ষেতে পার্থেনিয়াম আক্রমণ করেছে। নওগাঁ ও রাজশাহীতে আলু এবং গম ক্ষেতেও আক্রমণ করেছে বিষাক্ত এ আগাছা। এটি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর উল্লেখ করে ড. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘গরু, ছাগল, ভেড়া আগাছাটি খেলে প্রথমে মুখে ঘা ও চর্মরোগ হয়। ধীরে ধীরে মাড়িতে ঘা ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশি পরিমাণে খেলে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয় পশু। আর মানুষের দেহে পার্থেনিয়ামের স্পর্শে প্রথমে চুলকানি, চর্মরোগ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে একজিমার আকার ধারণ করে। এমনকি শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমাসহ জটিল রোগেরও কারণ হতে পারে এ আগাছা।’

রাসায়নিক দিয়ে এ আগাছা দমন করা খুবই কষ্টকর উল্লেখ করে এ গবেষক আরও বলেন, ‘ফুল আসার আগে গ্লাইফোসেট নামক আগাছানাশক প্রতিলিটার পানিতে ১০-১৫ মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করে এ আগাছা দমন করা সম্ভব। এছাড়া সাধারণ লবণের ১৫-২০ শতাংশ দ্রবণ অর্থাৎ প্রতিলিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করে পার্থেনিয়াম দমন করা যায়।’ বীজ ও খাদ্যশস্য আমদানিতে উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইনের প্রয়োগসহ জনসচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন ড. ইলিয়াছ।

এদিকে সায়েন্স অ্যালার্ট নামে এক জার্নালে পার্থেনিয়ামের সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন ভারতীয় চার গবেষক প্রেম কিশোর, একে ঘোষ, বিআর মৌর্য ও সুরেন্দ্র সিং। ‘পার্থেনিয়াম ব্যবস্থাপনা শতাব্দীর একটি বড় উদ্বেগ হিসেবে থাকবে’ উল্লেখ করে তারা জানান, পার্থেনিয়াম একটি সবুজ সার, কম্পোস্ট, জৈব নিয়ন্ত্রণ ও মাটির উন্নতি ঘটাতে পারে যা মাটির ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যকে উন্নত করতে পারে। এটি সহজেই গ্রহণ করা যায় এমন ম্যাক্রো-পুষ্টির উৎস। মাটিতে পার্থেনিয়ামের সমন্বিত ব্যবহার মাটির ভৌত রাসায়নিক, জৈবিক ও পুষ্টিগুণ পরিবর্তন করে। 

মাটির স্বাস্থ্য ও ফসলের কর্মক্ষমতা পরিবর্তনে এর কার্যকারিতার কারণে কৃষিতে পার্থেনিয়ামের প্রচুর সম্ভাবনা দেখতে পান এ গবেষকরা। তারা বলছেন, পার্থেনিয়ামে থাকা কম্পোস্ট উপাদান ফলন বাড়ায়। গত দুই দশকের অসংখ্য গবেষণার একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা এ গবেষণায় স্থান পেয়েছে, যা পদ্ধতিগতভাবে কৃষিতে পার্থেনিয়ামের ব্যবহার সম্পর্কে গুরুত্ব, সুযোগ ও আশঙ্কা তুলে ধরে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //