উন্নয়নের কোপ বনভূমির ওপর

বছর দুয়েক আগেও কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর কস্তুরীঘাট এলাকায় গেলে চোখে পড়ত বিশাল সবুজ বন। সেই প্যারাবন নিধন করে এখন গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা। বিষয়টি অজানা নয় পুলিশ প্রশাসন, পরিবেশ ও বন অধিদপ্তরের। ৪২ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবু থেমে নেই দখলদাররা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘ওদের সঙ্গে কি আমরা পেরে উঠি বলুন? ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো পাহারা দিতে হয়। বারবার ওপর মহলে জানিয়েও লাভ হচ্ছে না।’

কক্সবাজারেরই দরিয়ানগরে ছিল ঘন জঙ্গল। সেই বন কেটে ৫ একর জমিতে করা হচ্ছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স ইউনিভার্সিটির আরেকটি ক্যাম্পাস। বন বিভাগের তীব্র বিরোধিতার মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় জমি বরাদ্দ দেয়। এভাবে দেশে প্রতিদিন কমছে সবুজ। বাড়ছে দালানকোঠা, রাস্তাঘাট ও বসতি। কোথাও গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও বনের ভেতরেই ইটভাটার চুল্লিতে জ্বলে কাঠ। বৃক্ষ রক্ষায় সরকারের নানা কর্মসূচি ও কড়া নজরদারির মধ্যেও রক্ষা পাচ্ছে না অরণ্য। 

উন্নয়নের নামে বনভূমি বরাদ্দ: দেশে বনভূমি কমে যাওয়ার তথ্য ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবরে প্রকাশ করে বন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভূমিই বেদখল হয়ে আছে। প্রায় ৯০ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে এসব জমি দখল করেছে। সবচেয়ে বেশি বনভূমি বেদখল হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। জেলাটিতে ৫৯ হাজার ৪৭১ হাজার একর বনভ‚মি বেহাত হয়েছে। তবে বেদখল হওয়া বনভূমির তথ্য জানালেও কারা এসব জমি দখলে রেখেছেন, তা জানায়নি বন অধিদপ্তর।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত বছর এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এ পর্যন্ত বনভূমির প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ২৪০ একর জমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ করে নিয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি জবরদখল করা হলেও অধিদপ্তর কর্তৃক সর্বশেষ পাঁচ বছরে মাত্র ৮ হাজার ৭৯২ একর (৩%) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নকাজে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য দেড় লাখ একরের বেশি বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে বন মন্ত্রণালয়। এভাবে এ যাবৎ সাড়ে চার লাখ একর বনভূমি বন অধিদপ্তরের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বড় বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা), বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি), গ্যাসক্ষেত্র ও সড়ক কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে ধ্বংস হওয়া বনভূমি আনুষ্ঠানিক বরাদ্দের বাইরে।

কক্সবাজারের বনভূমি নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এক বছর ধরে গবেষণা করছে। গবেষণায় (১৯ মার্চ পর্যন্ত) দেখা গেছে, কক্সবাজারে বন ধ্বংসে এগিয়ে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। জেলায় মোট ২ লাখ ৬০ হাজার ৪৬ একর বনভূমির মধ্যে দখল হয়ে গেছে ৪৫ হাজার ৯৯০ একর জমি। অবৈধ দখলদার ৪৩ হাজার ৫৬৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬ প্রতিষ্ঠান। রোহিঙ্গাদের দখলে যাওয়া জমির পরিমাণ ৬ হাজার ১৬৪ একর। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৩৭২ একর বনভূমি।

বন বিভাগ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করা হয়েছে ১০ হাজার ৪৬০ একর। সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফে বেজাকে ৮ হাজার ৮৮৪ একর, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ২০২ একর ও ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হসপিটালকে ১৪ একর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বরাদ্দের তালিকায় আছে হর্টিকালচার, সড়ক ও জনপথ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, আবহাওয়া অধিদপ্তর, পর্যটন করপোরেশন, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১৯২৭ সালের বন আইন দিয়ে এখনো বন বিভাগ চলছে। এ আইনে নেই বনের সংজ্ঞা, বনের ধরন, বন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন কাজে বনের জমি ব্যবহার এবং বরাদ্দ প্রদানের বিষয়। এ সংক্রান্ত নেই কোনো বিধিমালা। ফলে ঢালাওভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বনভূমি। নতুন আইন প্রণয়নসহ আমূল পরিবর্তন করতে হবে। 

কমছে বন : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কোনো দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। বন বিভাগের ‘বাংলাদেশের বনভূমি ও বৃক্ষ সম্পদ সমীক্ষা প্রতিবেদন-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভ‚মির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, যা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হিসাবে বনের বাইরের গাছ আমলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু বন বিভাগের নতুন সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বনের বাইরে গাছের পরিমাণ মোট ভূমির ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এসব গাছের বেশিরভাগই বেড়ে উঠেছে মূলত সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে। সেই হিসাবে বনের ভেতর ও বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভ‚মির সাড়ে ২২ শতাংশ।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে ২০২০ সালে ৫৩ হাজার একরের বেশি বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২১১ একর। এছাড়া ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ লাখ সাড়ে ৯৬ হাজার একর বনভূমি ছিল, যা মোট ভূভাগের ১৬ ভাগ। ২০২০ সালে প্রায় ৫৩ হাজার ১২৮ একর বনভ‚মি ধ্বংস হয়েছে এবং বন বেশি উজাড় হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে, ৫১ হাজার ৮৯২ একর। সারা দেশে ১ হাজার ১৩৬ একর আদি বন ধ্বংস হয়েছে।

২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূখন্ডের ১৭ শতাংশ রক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত বন করতে পেরেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ২৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। যে কোনো মূল্যেই দেশের বনভূমি অবৈধ দখলমুক্ত করা হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বন আইন যুগোপযোগী করা দরকার। দায়িত্ব ও কর্তব্য সে আইনে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। সংরক্ষণভিত্তিক বন করা দরকার। বনকে বন ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনে বন ব্যবহার করতে হলে, সেখানে কী রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সেটি আইনে থাকতে হবে। কিন্তু বন কাটা যাবে না এ রকম আইন নেই। 

তিনি বলেন, বনগুলোর সীমানা চিহ্নিত করে বনের জমি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। কিন্তু এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই প্রথাগত বনবাসীদের বিরক্ত করা যাবে না। তাদের ওপরই বনের ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিতে হবে। যেখানে আদিবাসীরা আছে সেখানে সবুজ আছে। যেসব জায়গা বন বিভাগের দায়িত্বে সেসব এলাকা খালি হয়ে গেছে। বনায়নও করা হচ্ছে ইউক্যালিপটাস গাছের মতো বিদেশি গাছ দিয়ে। বন বিভাগের নীতিতে আছে বাণিজ্যিক বনায়ন।

জীববৈচিত্র্যের জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার বাইরে বাকিগুলোতে তারা বাণিজ্যিক বনায়ন করে। যে অধিবাসী জানবে বন থেকে জীবন ও জীবিকা চলবে তিনি বন ধ্বংস করবেন না। ভারতে বনবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ‘ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট-২০০৬’ করা হয়েছে। আর আমাদের দেশে বনবাসীর ওপর ঐতিহাসিকভাবে অবিচার করা হয়েছে। বন বিভাগ বলছে এরা দখলদার। বন রক্ষায় কমিউিনিটি ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। বন বিভাগ কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মনিটর করবে, কিন্তু বন দেখাশোনা করবে যারা বনের ওপর নির্ভরশীল তারা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //