অবশেষে হাওর সুরক্ষায় কঠোর আইন

দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে হাওর ও জলাভূমি। কিন্তু হাওর সুরক্ষা কিংবা ব্যবস্থাপনায় কোনো আইন নেই। ফসল ও মৎস্য সম্পদের বড় উৎস হলেও দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে হাওরাঞ্চল ও জলাভূমি। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাওর ও জলাভূমি রক্ষায় একটি কঠোর আইন করতে যাচ্ছে সরকার। 

ইতোমধ্যে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’-এর খসড়া করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। খসড়া আইন অনুযায়ী, হাওর এবং জলাভূমি দূষণ এবং দখলের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের জেল বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান জানান, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে একটি আইনের খসড়া হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করতে আরও দু-একটি মিটিং করা লাগতে পারে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য হাওর ও জলাভূমিসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের একটি রিট পিটিশনে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা আইন দ্রুত প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। এজন্য নতুন আইনটি করা হচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নদীগুলোর মতো হাওর ও জলাভূমির দখল-দূষণও বেড়ে চলছে। তা রোধে আইন করার উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু শুধু ভালো আইন করলেই চলবে না, তা বাস্তবায়নে সরকারকে কঠোর হতে হবে। কারণ আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে আইন কঠোর বাস্তবায়নের অভাবে অব্যবস্থাপনা দূর হয়নি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলা নিয়ে হাওরাঞ্চলের অবস্থান। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ হাওরাঞ্চল নামে এই এলাকাটি পরিচিত। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ে এ হাওরাঞ্চলের অবস্থান। হাওরাঞ্চলে সুনামগঞ্জ জেলাকে হাওরের ‘মা’ বলা হয়। এ ৭টি জেলায় ছোট-বড় অসংখ্যা হাওর আছে। এর মধ্যে ৩৭৩টি আকারে অনেক বড়। তাছাড়া অসংখ্য নদ-নদী ডোবা ও জলাশয় রয়েছে। হাওরের মাটি পলিগঠিত বিধায় খুবই উর্বর এবং প্রচুর ধান হয়। প্রচুর জলাশয় থাকায় অনেক মাছ উৎপন্ন হয়।

হবে হাওর ও জলাভূমি কোর্ট

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, অপরাধ বিচারের জন্য দেশে হাওর ও জলাভূমি কোর্ট নামে এক একাধিক কোর্ট থাকবে। প্রতিটি কোর্ট একজন বিচারকের নেতৃত্বে গঠিত হবে। সরকার নিযুক্ত প্রসিকিউটর কোর্টকে সহায়তা করবে। কোর্টের এখতিয়ারাধীন হাওর ও জলাভূমি সংক্রান্ত অপরাধ আমলে নেবে। কোর্ট প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারবে। এই আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য হবে। একই সঙ্গে এই আইনের অধীনে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতেও করা যাবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

যে অপরাধে যে শাস্তি

হাওর ও জলাভূমি থেকে পানি প্রত্যাহার করার ফলে যদি জলাভূমি শুকিয়ে যায় বা জলাভূমি এলাকার প্রতিবেশ বা জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের জেল বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে বলে খসড়া আইনে জানানো হয়েছে।

পানির ধারক স্তরের নিরাপদ সীমা ব্যাহত হয় এমনভাবে পানি উত্তোলন বা আহরণে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা জরিমানার মুখে পড়তে হবে।

পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

হাওর ও জলাভূমির পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো পরিবর্তন আনলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ বছরে কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে। পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাওর ও জলাভূমিতে এমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করলেও এ শাস্তি পেতে হবে।

পানি দূষণের মাধ্যমে পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাওর ও জলাভূমিতে এমন কোনো দ্রব্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ফেললেও শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে।

শিল্প কারখানার অপরিশোধিত তরল বা কঠিন বর্জ্য হাওয়া ও জলাভূমিতে ফেলে পানি দূষিত করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে।

যান্ত্রিক জলযান চালিয়ে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষিত হাওর ও জলাভূমি এলাকায় পানি বা শব্দ দূষণ করলে সর্বোচ্চ এক বছরের জেল বা এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।

অনুমোদিত জলমহাল বা পাথরমহাল ছাড়া হাওর ও জলাভূমি থেকে বালু বা পাথর উত্তোলনের শাস্তি ৫ বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা। হাওর ও জলাভূমির অবৈধ দখল, ভরাট ও অনুমোদিত খনন; হাওর ও জলাভূমি থেকে অবৈধভাবে সম্পদ আহরণ; হাওর ও জলাভূমির অনুমোদিত পরিবর্তন বা রূপান্তরের ক্ষেত্রেও এ শাস্তি পেতে হবে।

এই আইনে উল্লেখ করা কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকারী বা প্ররোচনা প্রদানকারী বা প্রলুব্ধকারী অপরাধ সংঘটনকারীর মতো একই অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য হবেন এবং অপরাধীর মতো একইভাবে শাস্তি পাবেন বলে খসড়া আইনে জানানো হয়েছে।

হবে তহবিল, চালু হবে পুরস্কার

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় গবেষণায় হাওর ও জলাভূমি তহবিল নামে একটি তহবিল থাকবে। তহবিলের গঠন ও পরিচালনা পদ্ধতি বিধি দিয়ে নির্ধারিত হবে। খসড়া আইন অনুযায়ী, হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হাওর ও জলাভূমি তহবিল থেকে পদক ও পুরস্কার দেওয়া যাবে।

হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এই আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে। হাওর ও জলাভূমি এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল জল বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় অভয়াশ্রম বা স্থায়ী অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং সংরক্ষিত জলাভূমি এলাকা ঘোষণা করতে পারবে অধিদপ্তর। হাওর ও জলাভূমি এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছ থেকে বিধি দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ছাড়পত্র নিতে হবে বলে খসড়া আইনে জানানো হয়েছে।

হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় পরিষদ ও নির্বাহী কমিটি থাকবে। আইন বাস্তবায়নে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হাওর ও জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে।

জলাভূমি কমছে, বাড়ছে বন্যা

হাওর এলাকায় গত তিন দশকে ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমে চারশ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে; যে কারণে বন্যার ব্যাপকতা বাড়ছে, তা ভয়াবহও হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছর বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর করা গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭৩ হাওরে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ ১৯৮৮ সালে ছিল ৩০ হাজার ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। ৩২ বছরে তা কমে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০৭ বর্গকিলোমিটারে। এ সময়ে হাওরাঞ্চলে সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রায় পৌনে চারগুণ বেড়ে ১০৩২ থেকে ৩৮৭২ বর্গকিলোমিটার হয়েছে।

গত বছরের ২৪ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘হাওর এলাকার ভূমি ব্যবহারের কয়েক দশকের পরিবর্তন ও এবারের ব্যাপকতা : গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা’ শীর্ষক সংলাপে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //