সিঙ্গাপুর থেকে আনা বিটিআই কি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?

ক্রমেই ভয়ংকর হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক-বর্ষা জরিপের ফলাফল বলছে, রাজধানীর প্রায় সব বাসিন্দাই ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিতে। আর জরিপের আওতাভুক্ত ওয়ার্ডের মধ্যে প্রতিটিই ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। এর সঙ্গে ভুল নগরায়ণের সম্পর্ক পেয়েছেন গবেষকরা।

কীটতত্ত্ববিদরাও বলছেন, দেশে নগরায়ণের পরিসর বেড়েছে। উপজেলা এবং কোনো কোনো ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্তও এর প্রসার ঘটেছে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকায় এডিস মশার যে প্রজাতিটি ডেঙ্গু ছড়াতে ভূমিকা রাখছে, সেটি মূলত কম গাছপালা ও কংক্রিটে আচ্ছাদিত জায়গায় বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। 

ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করা মশা নিয়ন্ত্রণে এবার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। মশার লার্ভা ধ্বংস করতে সিঙ্গাপুর থেকে এনেছে ব্যাসিলাল থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এটা অনেক দেশে কার্যকর প্রমাণ হলেও বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকার আবহাওয়ায় বিটিআইয়ের প্রয়োগ কতটুকু যৌক্তিক- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন উঠেছে বিটিআইয়ের প্রয়োগের সময় ও স্থানের যৌক্তিকতা নিয়েও। 

বিটিআই এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। মশার লার্ভা ধ্বংস করে এটি। এর বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। পানিতে এটি প্রয়োগ করলে অন্য জলজ প্রাণীরও ক্ষতি হয় না। বিটিআই মশা, মাছি এবং অন্যান্য পতঙ্গের লার্ভা মেরে ফেলে। লার্ভা ধ্বংস হওয়ার ফলে মশার সংখ্যা কমে যায়। আর মশার বংশ বৃদ্ধি না হলে চিকুনগুনিয়া, ইয়োলো ফিভার, ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) বলছে, মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো বিটিআইয়ের প্রয়োগ। বিটিআই মূলত লার্ভা বা ডিম ধ্বংস করে। তবে এটি প্রাপ্তবয়স্ক মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে মাটিতেই জন্মায়। 

বিটিআইয়ের প্রয়োগ নিয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেই মশার লার্ভা ধ্বংসের জন্য ব্যাকটেরিয়াটি কিনেছি। এটা নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। প্রয়োগ হলে এর সফলতার ওপর নির্ভর করে সামনের কর্মসূচি ঠিক করা হবে।’

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাল ও জলাশয় ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঢাকায় বিটিআই প্রয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘কলকাতার তুলনায় ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। তাছাড়া বিটিআই প্রয়োগ করতে হয় পানিতে। ঢাকায় যে পরিমাণ অপরিষ্কার খাল-জলাশয় রয়েছে তাতে কী বিপুল পরিমাণ বিটিআই লাগবে সেটা হিসাব করে দেখেছেন সংশ্লিষ্টরা?’

কলকাতায় বিটিআই প্রয়োগে সফলতা পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে এ গবেষক বলেন, ‘কলকাতায় পরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। সেখানের জলাশয়গুলো ঢাকার মতো বাজে অবস্থা না। তাই আমারা ধারণা করছি বিটিআই দিয়ে ঢাকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর দুটি কারণ আছে- প্রথমত বিটিআই প্রয়োগ করতে হয় বর্ষার আগে। তখন প্রয়োগ করা গেলে কার্যকরী ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন প্রয়োগে কোনো ফল আসবে না। দ্বিতীয়ত আমার আয়ত্তাধীন এলাকায় বিটিআই প্রয়োগ করা যায়। যেমন বাসা-বাড়িতে, অফিস-আদালতের মতো লিমিটেড স্পেসে। পুরো ঢাকায় আপনি কোথায় কতটুকু বিটিআই প্রয়োগ করবেন? এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার যৌক্তিকতাও ভেবে দেখতে হবে।’

বিটিআই প্রয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাকিলা নার্গিস খান। তিনি বলেন, ‘সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি বিটিআই প্রয়োগ করা হয় তাহলে ভুল হবে বলে মনে করি না। তবে এটা ঠিক যে, বিটিআই প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ফ্যাক্টর আছে যেগুলোতে সাবধান থাকতে হবে। আমার ধারণা, ডিএনসিসি সে ফ্যাক্টরগুলো মেনেই এটি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর পানি নোংরা বা পরিষ্কার বিটিআই প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় বিষয় না- বিষয় হলো কতটুকু পানির মধ্যে কতটুকু প্রয়োগ করতে হবে। বিটিআই কিন্তু মশা মারতে পারবে না। এটা লার্ভা মারবে।’

বিটিআই প্রয়োগের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি ও রোদ দুটি ফ্যাক্টরই বিবেচনায় নিয়ে ব্যাকটেরিয়াটি ছাড়তে হবে। তবে বিটিআই খুবই ব্যয়বহুল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে এত ব্যয়বহুল পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের যৌক্তিকতা নিয়েও ভাবতে হবে। কেননা এটা পরিমাণেও বেশি লাগবে। আমার পরামর্শ হলো, যত সস্তায় মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ততই ভালো হবে।’

বিটিআই প্রয়োগ করে এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে কলকাতা সিটি করপোরেশন। কলকাতার সঙ্গে ঢাকার আবহাওয়ার মিল থাকায় ঢাকায়ও বিটিআই সফলতার মুখ দেখবে বলে দাবি করেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিটিআই সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশসম্মত একটি মশক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি। আমরা দেখেছি এটা ঢাকার আবহাওয়ার জন্য প্রয়োগযোগ্য। তবে বিটিআইয়ের সফলতা পেতে হলে অবশ্যই সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সঠিক বিরতিতে ও সঠিকভাবে এর প্রয়োগ করতে হবে।’

জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বিটিআই প্রয়োগের ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন আর কোনোভাবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তবে বিটিআই প্রয়োগে লার্ভা ধ্বংস করে ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা তো করতে হবে। আর ডিএনসিসি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে বিটিআই প্রয়োগ করে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ কীটনাশক প্রয়োগ পদ্ধতি থেকে তারা বেরিয়ে আসবে বলে আশা করি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //