সাইবার নিরাপত্তা আইনেও সমালোচনা

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করছে সরকার। গত ৭ আগস্ট সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে মন্ত্রিসভার বৈঠকে। তবে সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।

খসড়া আইনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারায় বেশি মামলা হয়েছে এবং সমালোচিত, এমন ছয়টি ধারা প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এখনো অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। খসড়া আইনে কয়েকটি অপরাধের সাজা কমানো হয়েছে। তবে আগের ধারাগুলো বিদ্যমান। অপরাধ ও দণ্ডসংক্রান্ত ২২ ধারার মধ্যে মাত্র একটি বাতিল করা হয়েছে। অপরাধের তদন্ত ও বিচারসংক্রান্ত ১৬টি ধারার মধ্যে সবই খসড়ায় রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, যেসব ধারায় বেশি মামলা ও বিতর্ক হয়েছে সেগুলো এখনো অজামিনযোগ্য রয়েছে। নতুন আইনে সব ধারা জামিনযোগ্য করা উচিত। কারণ নতুন আইনে সামান্য কিছু শাস্তি কমিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমতে পারে, ব্যাপকতা কমবে না।

এছাড়া বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। দুটি আইনের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকমের। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন, সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের যেসব আপত্তি-উদ্বেগ ছিল, প্রস্তাবিত নতুন আইনেও সেসব দূর করা হয়নি। শুধু কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে।

 জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি বাতিলের সুপারিশ করেছিল। নতুন আইনে ২১ নম্বর ধারাটি অজামিনযোগ্য রয়ে গেছে। এছাড়া আটটি ধারা সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা আগেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যেগুলো সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা। এছাড়া সম্পাদক পরিষদ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বিবৃতিও দিয়েছিল, তাতে আইনটির ৯টি ধারার (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) মৌলিক কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল। এরপর গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার, নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা যারাই পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারাই এ নিয়ে বারবার বলেছেন যে সামগ্রিকভাবে এ আইন ও বিশেষভাবে কতিপয় ধারা অগ্রহণযোগ্য এবং তা আন্তর্জাতিক যেসব সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তুলনায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে কিছুটা উন্নতি আছে। তবে আইনটির অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা পুরোপুরি চলে গেছে এটা বলা যাবে না। তিনি বলেন, যে কোনো আইনের সবচেয়ে বড় সমালোচনার জায়গা বিচারের আগে আটক থাকা। কেউ যদি বিদ্বেষবশত কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে বলে আদালতে প্রমাণ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার বিধান থাকা উচিত। এটা পেনাল কোডে আছে। একই বিধান দেখতে পাবেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। আইনের অপব্যবহার ঠেকানোর জন্য এটা করতে হবে। অপব্যবহার রোধে এমন একটি ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনেও যুক্ত করা যেতে পারে। প্রতিটি সিভিল মামলার বাদী থাকে রাষ্ট্র। এই মামলায়ও ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে রাষ্ট্র বাদী হবে। মিথ্যা মামলা করে রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গের কারণে শাস্তি পেতে হবে।

বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাইবার নিরাপত্তা আইনও নিবর্তনমূলক। 

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা অজামিনযোগ্য বলা হতো। সাইবার নিরাপত্তা আইনে বেশির ভাগ ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। শুধু ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ নম্বর ধারা অজামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে যেসব ধারা অজামিনযোগ্য প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর কিছু জামিনযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আইনমন্ত্রী বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও আইনে প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা হতে পারে।

তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে অপব্যবহার ছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হলে সে অপব্যবহার বন্ধ হবে।

জানা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য ধারা আছে ১৪টি। নতুন আইনে আটটি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আগে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারা আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য ছিল। ফলে এখনো ছয়টি ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের সুযোগ বহাল থাকছে।

যেসব ধারায় সাজা কমেছে: সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধ ও দণ্ড সংক্রান্ত ২১টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে সাজা কমানো হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭/ক ধারায়, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বেআইনি প্রবেশের শাস্তি সাত বছর থেকে কমে প্রস্তাবিত আইনে তিন বছর হচ্ছে। ১৭/খ ধারার শাস্তি ১৪ বছর থেকে কমে হচ্ছে ছয় বছর।

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রপাগান্ডা সংক্রান্ত ২১ ধারা জামিনযোগ্য হচ্ছে, শাস্তি ১০ বছর থেকে কমে হচ্ছে সাত বছর।

ডিজিটাল জালিয়াতি সংক্রান্ত ২২ ধারাও জামিনযোগ্য হচ্ছে, সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হচ্ছে দুই বছর। ডিজিটাল প্রতারণা সংক্রান্ত ২৩ ধারার সাজা অপরিবর্তিত রেখে এটি জামিনযোগ্য করা হচ্ছে।

পরিচয় প্রতারণা সংক্রান্ত ২৪ ধারাও জামিনযোগ্য হবে, সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হবে তিন বছর। অনুমতি ছাড়া তথ্য সংগ্রহ সংক্রান্ত ২৬ ধারা জামিনযোগ্য হবে, সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হচ্ছে দুই বছর। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত ২৮ ধারাও জামিনযোগ্য হচ্ছে, এই অপরাধের সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হচ্ছে দুই বছর।

মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত ২৯ ধারার কারাদণ্ড বাদ দিয়ে জরিমানা পাঁচ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ৩১ ধারা হবে জামিনযোগ্য এবং সাজা সাত বছর থেকে কমে হবে পাঁচ বছর।

সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের ৩২ ধারায় সাজা ১৪ বছর থেকে কমে হচ্ছে সাত বছর। এ ছাড়া এটি জামিনযোগ্য হচ্ছে। বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ সংক্রান্ত ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে ‘হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ’ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপিত হবে প্রস্তাবিত আইনে। এই অপরাধের শাস্তি হবে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা। পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ৪৩ ধারা প্রস্তাবিত আইনে অপরিবর্তিত থাকছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //