৫ কোটি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায়

বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষের বিভিন্ন ধরনের থাইরয়েড সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এই রোগটিতে আক্রান্ত এমন অর্ধেকেরও বেশি মানুষ জানে না যে তারা এ সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া পুরুষদের তুলনায় নারীরা পাঁচ থেকে ১০ গুণ বেশি থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘সুস্থ মা, সুস্থ সন্তান এবং সুস্থ জাতি’ গড়তে থাইরয়েড বিষয়ে গণসচেতনতা প্রয়োজন। কারণ থাইরয়েড রোগ হৃদস্পন্দন, মেজাজ, শক্তি স্তর, বিপাক, হাড়ের স্বাস্থ্য, গর্ভাবস্থা এবং অন্যান্য অনেক শারীরিক কাজকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১০০ হরমোন বিশেষজ্ঞ থাইরয়েডের সেবা দিচ্ছেন। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে ২০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাজ করছেন।

মায়ের থাইরয়েড সমস্যা নবজাতকের ওপর 
চিকিৎসকরা বলছেন, মায়ের থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে এর প্রভাব নবজাতকের ওপর পড়ে। নবজাতকের থাইরয়েড হরমোনের অভাব শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে শিশু প্রতিবন্ধীতে পরিণত হতে পারে। এজন্য প্রতিটি নবজাতকের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে থাইরয়েড পরীক্ষা করা জরুরি। হরমোন নরমাল থেকেও থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। সাধারণত আয়োডিনের অভাবে গলাফুলা রোগ হয়ে থাকে, যাকে ঘ্যাগ রোগ বলা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বেশিরভাগ স্কুলগামী শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের আয়োডিনের অভাব রয়ে গেছে। আয়োডিন শরীরে অতি প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অজ্ঞতার কারণে থাইরয়েডের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় অনেকে দেরিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

হাইপো-থাইরয়েডিজম হলে, অল্প খাবার খেয়েও মানুষের ওজন বেড়ে যাবে, শরীর দুর্বল লাগবে। এসব রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে, নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত ঋতুস্রাবের সমস্যা হয়। অপরদিকে হাইপার থাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে বিপরীত লক্ষণ দেখা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ থাইরয়েড সমস্যা। তাই গর্ভাবস্থার সমস্যার ক্ষেত্রে গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শের পাশাপাশি থাইরয়েডের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমিন বলেন, বেশিরভাগ সময় এ রোগীরা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়। তবে এ রোগে মৃত্যু কম হওয়ার কারণে এ বিষয়ে মানুষ গুরুত্ব কম দেয়। 

থাইরয়েড রোগ কী?
থাইরয়েড গ্রন্থি সঠিক পরিমাণে হরমোন তৈরি করা থেকে বিরত থাকলেই রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এটাই থাইরয়েডজনিত রোগ বলে থাকেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক পাঠান বলেন, থাইরয়েড সাধারণত হরমোন তৈরি করে শরীরকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। থাইরয়েড গ্রন্থিতে খুব বেশি থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন হলে তা শারীরিক বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই অবস্থায় শরীরে জমে থাকা শক্তি খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়, একে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে। এটি হলে শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়, কারণ তখন শরীরে থাকা শক্তি দ্রুত নিঃশেষ হতে থাকে। এছাড়াও হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যায়, দ্রুত ওজন কমে যায়। এ কারণে মানব দেহে নার্ভাসনেসের উপসর্গ দেখা দেয়। এর বিপরীতে থাইরয়েড গ্রন্থি খুব কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে থাকলে অর্থাৎ হাইপোথাইরয়েডিজম রোগে ভুগলে শরীরে শ্রান্তি আসে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে যে কারও ওজন বেড়ে যায়, ঠান্ডা তাপমাত্রা সহ্য হয় না, ডিপ্রেশন এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার মতো অন্যান্য লক্ষণ ও উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। এগুলো উত্তরাধিকারসূত্রেও বহন করতে পারে মানুষ। এ ছাড়াও থাইরয়েডাইটিস, হাশিমোটো, গ্রেভস, হাইপারফাংশনিং থাইরয়েড নডিউল প্রভৃতি থাইরয়েড গ্রন্থি সংক্রান্ত রোগ হয়ে থাকে।

থাইরয়েড শরীরে কী কাজ করে?
থাইরয়েড একটি ছোট, প্রজাপতির আকারের মতো গ্রন্থি। এটি গলার মাঝখানে অর্থাৎ ভয়েস স্বর গ্রন্থির নিচে এবং শ্বাসনালির চারপাশে আবৃত থাকে। এটি একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি, দেহের প্রায় সকল বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। হৃদস্পন্দনের হার, শরীরের ওজন, কোলেস্টেরলের মাত্রা, পেশির বল বা শক্তি, শারীরিক তাপমাত্রা থাইরয়েড হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হয়। 

নারীরা বেশি আক্রান্ত
নারীদের ক্ষেত্রে থাইরয়েড সমস্যা বেশি লক্ষণীয়। তাদের থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যা পুরুষদের তুলনায় পাঁচ থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি। মাতৃগর্ভে শিশুর থাইরয়েড গ্রন্থি সঠিকভাবে তৈরি না হলে পৃথিবীতে আসার পর শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসতে পারে। সে কারণে গর্ভধারণের আগেই মায়ের থাইরয়েড সমস্যা আছে কি না তা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। 

অত্যধিক সক্রিয় হলে কী হয়? 
গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নুরে শারমিন বলেন, দেহে থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য হলে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এটা নারীদের বেশি হয়ে থাকে। তিনি বলেন, এই হরমোনের আধিক্য ঘটলে মানুষের মধ্যে অযথাই উদ্বেগ বাড়ে, বিরক্তি ভাব আসে এবং স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা দিয়ে থাকে। এ সময় রোগীর ঘুমাতে সমস্যা হয়, স্বাভাবিক ঘুম হয় না বা শান্তি অনুভব করে না। ওজন কমে যাওয়া সমস্যা, এর সঙ্গে থাইরয়েড গ্রন্থি বৃদ্ধি পেয়ে গলগ- হতে পারে। একই সঙ্গে পেশি দুর্বলতা দেখা দেয় এবং দেহে কম্পন অনুভব করে। তাপের প্রতি সংবেদনশীল বোধ করা এবং দৃষ্টি সমস্যা বা চোখের জ্বালা-পোড়া বোধ হতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয় 
হরমোন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলছেন, কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ এড়ানো যেতে পারে অথবা বিলম্বিত করা যেতে পারে। যেমন প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া কিছু সবজি না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, থাইরয়েড থাকলে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, পালং শাক একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে। এসব শাকসবজিতে গয়ট্রোজেন নামক এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই গয়ট্রোজেন থাইরয়েড গ্রন্থির আয়োডিন শোষণে বাধা দেয় এবং হাইপারথাইরয়েডিজমকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর বাইরে সয়া জাতীয় খাবারও এড়িয়ে চলতে বলছেন হরমোন বিশেষজ্ঞরা। সয়া জাতীয় খাবারগুলো হলো- সয়াবিন, সয়া দুধ ইত্যাদি। এসব খাবার খাওয়া এড়াতে না পারলে কম খাওয়া ভালো। এছাড়া ধূমপান বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। শারীরিক পরিশ্রম, যোগব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

থাইরয়েড কি নিরাময় হয়? 
থাইরয়েড কখনো সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। সঠিক চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্যকরভাবে চিকিৎসা চালাতে পারলে সুস্থ থাকা যায়। হাইপারথাইরয়েডিজম ওষুধ, তেজস্ক্রিয় আয়োডিন থেরাপি বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। অন্যদিকে হাইপোথাইরয়েডিজম থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। চিকিৎসা হচ্ছে অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ। এটা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে কমিয়ে দেয়। এছাড়া ওষুধের পাশাপাশি অস্ত্রোপচারও করা যায়। থাইরয়েড গ্রন্থিটি বেশি অ্যাক্টিভ পরীক্ষায় প্রমাণ হলে এর কিছু অংশ কেটে কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা, এতেও সুস্থ থাকা যায়। এছাড়াও রেডিও অ্যাক্টিভ আয়োডিন থেরাপি ব্যবহার করা হয়। এই আয়োডিনযোগে চিকিৎসাও ভালো কাজ করে। অ্যান্টি থাইরয়েড ওষুধ ব্যবহার করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা দেড় থেকে দুই বছর ব্যবহার করা হয়। তার পর এই ওষুধ তাকে বন্ধ করে দিতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, রোগী স্বাভাবিক থাকলে ওষুধ বন্ধ করাও যেতে পারে। তবে পরে যদি আবারও হয় এই ওষুধ দিয়ে তাকে আর চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ থাকে না। রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন দিয়ে হাইপার থাইরয়েডিজমের ভালো চিকিৎসা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, থাইরয়েড রোগের লক্ষণগুলো বুঝতে পারলে রোগ নির্ণয় করা সহজ হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //