সর্বজনীন পেনশন

জনবান্ধব কর্মসূচি হলেও বাস্তবায়ন জটিল

সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরোত্তর পেনশন প্রাপ্তির ভোগান্তি কারোর অজানা নয়। টেবিলে টেবিলে অফিসার থেকে অফিসার ঘুষ না দিলে পেনশনের ফাইল আটকে যেত। এই দুর্ভোগ ও ভোগান্তি দূর করতে নতুন পদ্ধতি চালু করেছে সরকার। এর মধ্যে গত ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। অনেকেই পেনশন কার্যক্রমে নিবন্ধিত হয়ে চাঁদা দেওয়া শুরু করেছেন। আবার অনেকেই সরকারি অফিসের হয়রানির কথা বিবেচনা করে দোটানায় রয়েছেন। নিজেদের জমানো অর্থ সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পেনশন প্রাপ্তিতে ভোগান্তির কোনো সুযোগ নেই। মেয়াদপূর্তির সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর শুরু হবে। 

চলতি বছরের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সর্বজনীন পেনশন-পদ্ধতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পেনশন-সুবিধার আওতায় আনা হবে। চারটি আলাদা স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে যথাক্রমে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে। এর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য প্রবাস; বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি; রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সমতা স্কিম। আরও দুটি কর্মসূচি চালুর চিন্তা করছে সরকার। একটি শ্রমিক শ্রেণির জন্য, অপরটি শিক্ষার্থীদের জন্য। পর্যায়ক্রমে সরকারি কর্মচারী এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। 

সূত্র জানায়, গত ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পেনশন কর্মসূচিতে চাঁদা দিয়েছেন মোট ৮ হাজার ২৩১ জন। ওই সময় পর্যন্ত যত ব্যক্তি চাঁদা দিয়েছেন, তার মধ্যে প্রগতি কর্মসূচির আওতায় ৪ হাজার ৩৭১ জন, সুরক্ষায় ২ হাজার ৭৪১, সমতায় ৯১০ ও প্রবাস কর্মসূচিতে চাঁদা দিয়েছেন ২০৯ জন।

পেনশনের কর্মসূচিগুলোর মধ্যে প্রবাস কর্মসূচিতে সাড়া কম পাচ্ছে সরকার। এ জন্য কর্মসূচিটিকে ঘিরে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। দেশে প্রবাসী আয়ে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তা দেওয়া হতে পারে এ পেনশন কর্মসূচির চাঁদার বিপরীতেও। গত জুলাইয়ের সরকারি হিসাবে, ১ কোটি ৪৯ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। কর্মসূচিটি তাদের জন্য। এদিকে নিবন্ধনের পর চাঁদা দিলে অন্য তিন কর্মসূচি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হলেও সমতা কর্মসূচির ক্ষেত্রে তা হতে একটু দেরি হবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করার পরই তা চূড়ান্ত হবে। তবে চূড়ান্ত না হলেও এ কর্মসূচির আওতায় পরের মাসের চাঁদা দেওয়া যাবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় কেউ কোনো ভাতা পেয়ে থাকলে এ কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়া যাবে না। সমতা কর্মসূচিটি দরিদ্র মানুষের জন্য, যাদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম। এ কর্মসূচিতে চাঁদার অর্ধেক টাকা দেবে সরকার। তাই কোনো ভাতাভোগী যাতে এ কর্মসূচিতে যুক্ত না হন, সে জন্যই মূলত যাচাই-বাছাই করা হবে। সমতা কর্মসূচিতে চাঁদার হার একটিই, আর তা হচ্ছে ৫০০ টাকা। প্রতি চাঁদাদাতার বিপরীতে সরকার অনুদান দেবে আরও ৫০০ টাকা করে। সমতা কর্মসূচিতে ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ৪২ বছর কেউ চাঁদা দিলে ৬০ বছরের পর থেকে চাঁদাদাতা মাসিক পেনশন পাবেন ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেনশন ব্যবস্থা নতুন হওয়ায় অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মানুষদের আগ্রহ সৃষ্টি করা, মানুষদের চাঁদা জমা দেওয়ার সক্ষমতা, এই ফান্ডের যথার্থ ব্যবস্থাপনা, হয়রানির আশঙ্কা দূর করা। সর্বজনীন পেনশন একটি জনবান্ধব কর্মসূচি হলেও এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি জটিল। যেসব উন্নত দেশে এই কর্মসূচি সফল হয়েছে, সেসব দেশের অধিকাংশ মানুষের পেনশন স্কিমে চাঁদা দেওয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের সেই সামর্থ্য নেই। তারপরও বিষয়টি নিয়ে জনমনে যেসব প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরি। এই কর্মসূচির আওতায় সব কর্মক্ষম নারী-পুরুষকে নিয়ে আসতে হলে ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।

পেনশনের আওতায় স্বকর্মে নিয়োজিত পেশাজীবীদের আনার কথা বলা আছে। এসব পেশায় যারা আছেন, তাদের আয় দিয়ে দৈনন্দিন জীবন চালানোই যেখানে দুরূহ, সেখানে পেনশন স্কিমে চাঁদা দেবেন কীভাবে? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উপার্জন করেন না এমন গৃহিণীরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন; তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের আয় থেকে চাঁদা জমা দেবেন। দেশের শ্রমিকদের বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, যাদের বেশির ভাগেরই নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাদের পাশাপাশি বেকারদের এই কর্মসূচির আওতায় আনতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

কোটি কোটি মানুষের নামে পৃথক হিসাব খোলা, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা হবে কিনা, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত কিস্তি দিয়ে ঝামেলা ছাড়াই পেনশন পাওয়া যাবে কি না সেই সংশয়ে আছেন অনেক গ্রাহক। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার বিষয়ে এখনো নেতিবাচক মনোভাব তো আছেই। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের টাকা নিয়ে হয়রানির নজির কম নয়। নতুন পেনশন স্কিমে সেই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি হয় কিনা, সেই চিন্তায় আছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জাহানারা বেগম। এ কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখনো নিজের নামে স্কিমটি চালু করার সাহস করছেন না তিনি। তিনি বলেন, এক সময় দেখা যাবে কোটি কোটি লোক স্কিম খুলছে। আমি আজকে স্কিম খুললে মিনিমাম দশ বছর পর পেনশন পাব। বাংলাদেশের কোনো সরকারি অফিসে গেলে তো ভোগান্তি হয়ই, টাকা পয়সার বিষয় হলে আরও হবে। তখন দেখা যাবে পেনশনের জন্য সরকারি অফিসে ছুটতে ছুটতে, টাকা দিতে দিতে আমার আসল টাকাটাই থাকছে না।

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, এটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য একটি কর্মসূচি। তবে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বা কাজ পেতে ২৮ থেকে ৩০ বছর সময়ে লেগে যায়। তাই কর্মসূচির শুরুর বয়স ১৮-এর পরিবর্তে ২৪ করা উচিত। অন্যদিকে সরকারি অফিসগুলোতে ভোগান্তির একটি বিষয় আছে। সেটি সমাধানে এই পেনশন স্কিমের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ব্যাংকের কাছে দিলে ভালো। আলাদা অধিদপ্তর হলে সেখানে ভোগান্তির আশঙ্কা থেকে যায়। 

এ বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, পেনশন পেতে দীর্ঘসূত্রতা বা হয়রানির কোনো সুযোগ নেই, কারণ সব গ্রাহকের থেকে কিস্তি সংগ্রহ এবং পেনশন দেওয়ার সম্পূর্ণ লেনদেন অনলাইনে সম্পন্ন হবে। সেটাও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। কিস্তি দাতার বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর তার ব্যাংক হিসাবে অথবা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মাসিক পেনশন পৌঁছে যাবে। পেনশনের আর্থিক লেনদেন সব কিছুই হবে অনলাইনে। গ্রাহকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আমাদের কাছে আছে, তার অ্যাকাউন্টটি পেনশন দেওয়ার উপযুক্ত হলে সেই অ্যাকাউন্টে পেনশনের টাকা অটোমেটিক চলে যাবে। কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা লাগবে না। 

এর আগে সরকারি পেনশন পেতে হয়রানি দূর করতে ‘পেনশন সহজীকরণ নীতিমালা-২০২০’ জারি করা হয়েছিল। ওই নীতিমালা অনুযায়ী লেনদেনের সব কাজ বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে করতে হয়।

গোলাম মোস্তফা বলেন, পেনশন নিতে এক সময় দুর্ভোগ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো অভিযোগ শুনবেন না। কেননা এই টাকার লেনদেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হতে হয়। অ্যাকাউন্টসে একটি পেনশনের ফাইল ১০ দিনের বেশি রাখার নিয়ম নেই। 

এদিকে সুবিধাভোগীরা কিস্তি বাবদ যে অর্থ দেবে সেটার তহবিল ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, কীভাবে এবং কোথায় পেনশন তহবিল বিনিয়োগ হবে, লভ্যাংশ কীভাবে বণ্টন হবে, সেগুলো নিয়ে অস্পষ্টতার মধ্যে থাকার কথা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। পেনশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে এই তহবিল সরকারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। যেসব বিনিয়োগে ঝুঁকি কম সেদিকেই বিনিয়োগ করা হবে। যদি ফান্ড আরও বড় হয় তাহলে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হতে পারে। এটা সময়ের পরিক্রমায় হবে। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা তৈরি হচ্ছে, সেই মোতাবেক সব হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //