সমীক্ষা ছাড়াই অনুমোদন: বেহাল ১৯ হাজার কোটি টাকার পাঁচ প্রকল্প

স্বাধীনতার পর থেকেই প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশন। সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, যাচাই-বাছাই এবং অনুমোদনে সংস্থাটি মুখ্য ভূমিকায় থাকে। তাদের নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা সব প্রকল্পে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দ্রুত প্রকল্প অনুমোদন দিতে গিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ক্ষেত্রেও মানা হয় না এ বিধান। ফলে তা বাস্তবায়নের সময় নকশা পরিবর্তন থেকে শুরু করে তৈরি হয় নানা জটিলতা। একই সঙ্গে বাড়ে প্রকল্প মেয়াদ। বাড়তি ব্যয় বহনে বাধ্য হয় সরকার। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই অনুমোদন পাওয়া ১৯ হাজার কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি প্রকল্পের বেলায়ও ফুটে উঠেছে বেহাল চিত্র। 

দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ১৫ মিটার পর্যন্ত সেতু নির্মাণ
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ১৫ মিটার পর্যন্ত সেতু নির্মাণের প্রকল্প নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরে দুই বছর সময় বাড়ানো হলেও এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। ৫ হাজার ২০০ কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল এ প্রকল্পের মাধ্যমে। তবে এসব সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অ্যাপ্রোচ সড়ক দেবে যাওয়া, সড়কের চেয়ে সেতুর বেশি উচ্চতা, খাল সংকুচিত করার মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রেলিংয়েও ভাঙন দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যে। সর্বোপরি নকশায় দুর্বলতা ছিল বলছে প্রকল্প মনিটরিংয়ের একমাত্র সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করার কারণেই এমন নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। 

প্রকল্পটি নিয়ে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২২তম বৈঠকে সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৫ মিটার সেতু প্রকল্পের বেশির ভাগ ব্রিজে ওঠানামার অ্যাপ্রোচ সড়কের মাটি সরে যাওয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ছোট নদীর উপর নিচু ব্রিজ করায় নৌকা চলাচল করতে পারছে না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেন তিনি।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভবন সম্প্রসারণ 
সারা দেশে ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণে ৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ২০১৭ সালে এসব কাজ শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনে অর্থাৎ সাড়ে চার বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই দফায় বাড়ানো হয় দুই বছর মেয়াদ। এ বছরের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত মার্চ পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ, ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ১৯ শতাংশ অর্থ। ১২৫টি বিদ্যালয়ের বিদ্যমান ভবন উপরের দিকে সম্প্রসারণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ১০২টিতে কাজের সুযোগ রয়েছে। বাকি ২৩টি বিদ্যালয়ে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কোনো ভবনই নেই। সিদ্ধান্তহীনতায় বন্ধ রয়েছে জেলা শহরের ১৭২টি বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ। এখানেও সম্ভাব্যতা যাচাই না করাকে বড় দুর্বলতা বলছে আইএমইডি। 

প্রকল্পটিতে ফিজিবিলিটি স্টাডি না হওয়ায় আগে থেকে কিছু কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা যায়নি বলে জানান আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরের মহাপরিচালক মু. শুকুর আলী। তবে এখন থেকে স্টাডি করায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান সরকারের এ যুগ্মসচিব। তিনি বলেন, ‘স্কুলের চাহিদা সার্ভেকে সম্ভাব্যতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু যথাযথ স্টাডি হলে আগেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত হতো। এতে সময়মতো এবং সহজে কাজ করা যেত।’ তাই সব ধরনের প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দেন তিনি। 

টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ
একইভাবে ডিজিটাল দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে ২ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। ২০২০ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীকালে ২৮ শতাংশ বা ৭২১ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোয় মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে কেবল ৭৬ শতাংশ অর্থ। আর বিটিসিএলের পুরাতন নেটওয়ার্ক পরিবর্তন করলেও মাত্র ২ শতাংশের কম টেলিফোন রূপান্তরিত করা হয়েছে। ধারণক্ষমতার বেশির ভাগই থাকছে অব্যবহৃত। দেওয়া যাচ্ছে না নতুন সংযোগও। সম্ভাব্যতা যাচাই না করাকেই এ প্রকল্পের দুর্বলতা বলছে আইএমইডি। 

আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার
খাদ্য মজুদ বাড়তে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নামের একটি প্রকল্প নেয় খাদ্য অধিদপ্তর। ১৯শ কোটি টাকায় ২০১৪ থেকে ২০২০ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ে। ব্যয় ৮৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। মেয়াদ এ বছরের অক্টোরব পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু ১০ বছরে এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪৯ শতাংশ। আটটি স্টিল সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত আগ্রগতি ৪৭ শতাংশ মাত্র। এর পিছনেও যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। 

আয়রন ব্রিজ প্রকল্প
বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন স্থানে লোহার ব্রিজ সংস্কারের জন্য আয়রন ব্রিজ প্রকল্প গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। ১৮শ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এক বছর মেয়াদ এবং ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ৮০৫টি ব্রিজ নির্মাণের কথা থাকলেও এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৫৮ শতাংশ। এক বছরে বাকি কাজ শেষ করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোড খাড়া হওয়ায় কিছু স্থানে দুর্ঘটনার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলছে আইএমইডি। এ ক্ষেত্রেও প্রকল্প নিয়ে করা হয়নি যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই। 

এমন আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় নানা ধরনের জটিলতার বিষয়গুলো সামনে এসেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সারগুদাম নির্মাণ, উপজেলায় অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন, নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ। গ্যাস অনুসন্ধানে রিগ মেরামত প্রকল্পে দেখা গেছে, এমন রিগ মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যার উপযোগিতা আর নেই। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় বিষয়টি আগে জানা যায়নি। 

এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মামুন আল-রশীদ বলেন, ‘প্রকল্প অনুমোদনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কোনো বিকল্প নেই। কমিশনের এটা নিশ্চিত করা উচিত। তা না হলে প্রকল্পের ব্যয় এবং মেয়াদ বেড়ে যায়। করোনার মতো বড় কোনো দুর্যোগ না থাকলে এটা বাধ্য করতে হবে কমিশনকে।’ 

সম্ভাব্যতা ছাড়া প্রকল্পের প্রকৃত চিত্র এবং চাহিদা বোঝা যায় বলে জানান আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এটা হলে ব্যয় কমে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নও ভালো হয়।’ প্রধানমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে ভবিষ্যতে স্টাডি ছাড়া বড় কোনো প্রকল্প অনুমোদন পাবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। 

প্রকল্পে সুফল পেতে সমীক্ষার বিকল্প নেই জানিয়ে প্রকৌশলী মো. আব্দুস সোবহান বলেন, ‘আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রকল্প গ্রহণ হয় বাস্তবিক সমীক্ষা ছাড়াই। তাই তো বিশাল প্রকল্প নেওয়া হয়, কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, কিন্তু তার সুফল মানুষ পায় না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //