ভয়াবহ আকারে বিস্তৃত হয়েছে ডেঙ্গু; ঢাকার প্রায় প্রতি ঘরেই এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রয়েছে। যা নিয়ন্ত্রণে জোরালো জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতার কোনোটাই নেই।
রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন দেশে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার কার্যকর ব্যাসিলাস থুরিনজিয়ানসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঁচ টন বিটিআই আমদানি করে। কিন্তু চুক্তি অনুসারে সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই না এনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নামহীন কোম্পানি থেকে ৫ টন বিটিআই এনেছে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ফলে মশা নিধনে বিটিআই বা ব্যাসিলাস থুরিনজিয়ানসিস ইসরায়েলেনসিস প্রয়োগ করার চেষ্টা হলেও শুরুতেই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিখ্যাত কোম্পানির তৈরি বিটিআই আনার কথা বললেও আনা হয়েছে নকল বিটিআই।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পূর্বের সব রেকর্ড অতিক্রম করে এক লাখ ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ৬শর কাছাকাছি। এর আগে এত বেশি মানুষ বছরের প্রথম ৮ মাসের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড নেই। এই আগস্টে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৩৪২ জনের। আক্রান্তদের ৬২ শতাংশ পুরুষ হলেও ডেঙ্গুতে মৃতদের ৬৪ শতাংশই নারী। রাজধানী ঢাকা ছেড়ে ডেঙ্গু এখন গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
এতদিন বলা হতো ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। কিন্তু এখন নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে বলে কীটতত্ত্ববিদরা প্রমাণ পেয়েছেন। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ঢাকাতেই ডেঙ্গু বেশি, কারণ মশা নিধনে ঢাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সিটি করপোরেশনের মশা নিধনে যথেষ্ট অবহেলা রয়েছে। মশা নিধনে মিডিয়া কাভারেজের প্রতিই তাদের নজর বেশি। একই ধরনের পরিবেশ ও আবহাওয়ার পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতা সিটি করপোরেশনে থাকলেও তারা মশা অথবা ডেঙ্গুরোগ নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও ঢাকা একেবারেই ব্যর্থ।
জনসম্পৃক্ততা নেই
ঢাকার সর্বত্রই ডেঙ্গু জীবাণু বহনকারী এডিস মশা থাকলেও বিশেষত কয়েকটি অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। প্রধানত নিম্ন আয়ের মানুষ বাস করে এলাকাতেই এডিস মশা বেশি। যাত্রাবাড়ী, মুগদা, বাড্ডা, মিরপুর এলাকার বেশি রোগী আসে হাসপাতালে। আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক প্রয়োগ অথবা চিকিৎসার পাশাপাশি জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন। স্থানীয় জনগণকে জড়িত করে মশক নিধন কর্মসূচি পালন করতে হবে। স্থানীয়রা জানে কোথায় কোথায় মশা জন্মে। স্বেচ্ছাভিত্তিতে মশক নিধনে তাদের কাজে লাগাতে পারলে ফল ভালো দেবে, কিন্তু আমাদের সিটি করপোরেশন এর ধারে-কাছেও নেই। প্রয়োজনে নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে ঘরে বিনামূল্যে মশারি বিতরণ করতে হবে।
নকল বিটিআই
গত ৩ আগস্ট বিটিআইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার ৪ দিন পর ৭ আগস্ট ঢাকার কোথাও কোথাও বিটিআই প্রয়োগও শুরু করে ডিএনসিসি। প্রতি কেজি বিটিআই তিন হাজার ৩৮৫ টাকা ২০ পয়সা দরে পাঁচ টনের দাম পড়েছে এক কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা। বিটিআইয়ের প্যাকেটের গায়ে থাকা তথ্য অনুযায়ী এর উৎপাদক সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড তাদের নাম ব্যবহার করে অন্য সংস্থার বিটিআই আনায় প্রতিবাদ করে বলে ব্যাপারটি মিডিয়ায় আসে। এর পরই ডিএনসিসি বিটিআই প্রয়োগ বন্ধ রেখেছে। সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ‘স্ক্যাম অ্যালার্ট’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়ে বলেছে, ‘আমাদের নজরে এসেছে যে বাংলাদেশের মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কোম্পানি লিমিটেড নামক এক প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে পাঁচ টন বিটিআই লার্ভিসাইড সরবরাহ করেছে। পণ্যটির প্যাকেটে বেস্ট কেমিক্যালের সিল থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আমাদের সরবরাহ করা নয়।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএনসিসিকে যে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট বিটিআই সরবরাহ করেছে, তাদের বিটিআই আনার সরকারি নিবন্ধন ও লাইসেন্স কোনোটাই নেই। কীটনাশক আইন অনুযায়ী পণ্যটিতে কীটনাশকের প্যাকেটের গায়ে যেসব তথ্য থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেটিও নেই। কোনো ধরনের ফিল্ড টেস্ট ছাড়াই এই ‘নকল’ কীটনাশকটি প্রয়োগ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এটা শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh