যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে উদ্বেগ

গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারী বাংলাদেশিদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান। 

ম্যাথু মিলার বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করছে তাদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত আছেন। ভিসানীতির আওতায় চিহ্নিত ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গত ২৪ মে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে ভিসানীতি ঘোষণা করেছিলেন। তখন বাংলাদেশ সরকার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, ভিসানীতি যেন বস্তুনিষ্ঠতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, সরকার ও বিরোধী, সব পক্ষের জন্যই ভিসানীতি প্রযোজ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার প্রায় চার মাসের মাথায় গতকাল তা প্রয়োগ শুরু করার ঘোষণা এলো।

এর পরই সর্বত্রই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মহল টেলিফোনে একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছেন, কারা কীভাবে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় এলেন। এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার এক ধরনের মরিয়া চেষ্টা দেখা গেছে। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ব্যক্তি ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় এবং আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মার্কিন ভিসানীতিতে গণমাধ্যমও যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।

ভিসানীতি কেবল নির্বাচনে প্রভাব নয় 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল নির্বাচনে প্রভাব রাখবে না বরং নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। সরকার যদি এটি উপলব্ধি করতে পারে তাহলে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছে। এখন যা করার আমাদেরই করতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। 

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সরকার যে কোনো মূল্যেই নির্বাচনের আয়োজন করতে চাইলে ভিসানীতি খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। অন্যদিকে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমরা যদি আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেন, বিভিন্ন সংস্থার অনুদানের বিষয়ে মনোযোগী হই তাহলে এটি অবশ্যই প্রভাব রাখবে। বিষয়টা হচ্ছে সরকার নির্বাচনটাকে কীভাবে দেখছে? নির্বাচনের পর দেশ তো চলতে হবে। আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া, অর্থ সহায়তা, বাণিজ্য, দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি এ সব বিষয়ই এটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এসব কথা মাথায় রাখলে সরকার নমনীয় হতে পারে। তবে আশঙ্কা হচ্ছে সরকার হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকাকেই মুখ্য মনে করছে। তারা মনে করছে নির্বাচন পরবর্তী ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। 

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনে নয়, বরং আমাদের আচরণে প্রভাব রাখলে আমরা বেশি উপকৃত হবো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে এটি শুরু করেছে। আমরা যদি এটি উপলব্ধি করতে পারি তাহলে আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। এটা বিব্রতকর যে বাইরের লোককে এসে বলতে হচ্ছে যে, আমরা আত্মঘাতী পথে চলছি। 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলবে। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনেক সংস্কার প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করতে চাই ওনারা (সরকার) ভালো নির্বাচন দেবেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আসন্ন নির্বাচন হবে না। 

রাজনৈতিক দলগুলোর সতর্ক প্রতিক্রিয়া 

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রয়োগ শুরুর বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা অপেক্ষা করছি, বোঝার চেষ্টা করছি ভিসানীতির উদ্দেশ্য কী। যদি শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করা হয়ে থাকে, তাহলে স্বাগত জানানো হবে।’ 

বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, যারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে মাঠে আছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি ভিসানীতি প্রয়োগ হয় তাহলে মানুষ এটাকে স্বাগত জানাবে। আর যদি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে বাধাগ্রস্ত করতে এই ভিসানীতি প্রয়োগ হয় তাহলে মানুষ এটাকে ভালোভাবে দেখবে না।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আন্তরিক আছি। সেভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। এই নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘আমেরিকা আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কথা বলে নির্বাচন নিয়ে অতি উৎসাহ দেখায়। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেখি না। তাদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট বোঝা যায়।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো নীতি ঘোষণা করে তখন তার বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হলো। এখন এই ভিসানীতির প্রয়োগ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্য গণতান্ত্রিক দেশও শুরু করবে। আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় এবং এতে বাধা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করেছে। সরকারের পাশাপাশি বিরোধী পক্ষের সদস্যদের ওপরও ভিসানীতি প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, সরকারের দায় অনেক সময় দেশের সাধারণ জনগণকেও দিতে হয়। তাই সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পারে।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘কোনো দেশ বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপ করুক তা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ভালো বলে মনে করি। তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। তাদের ভিসানীতি প্রয়োগের বিষয়ে আমাদের আপত্তি-অনাপত্তির কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি অনুযায়ী কাজ করছে।’

যারা শঙ্কিত তারা সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করবে 

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে তাদের ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এখন তারা সেটির প্রয়োগ শুরু করল। কাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটি তারা বলেনি। কিন্তু বোঝা যায় তারা কিছু নাম নির্বাচন করেছে। নামগুলো আমরা জানি না। এতে বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব পার্থক্য হচ্ছে না। যারা চিন্তিত, তাদের চিন্তা কিছুটা বেড়েছে। কিছু কিছু মানুষ যারা নিজেদের এক্ষেত্রে শঙ্কিত মনে করেন, তারা সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করবে। তিনি আরও বলেন, এটি ইতিবাচক হতে পারে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবাই আরও সতর্ক হবে যেন নির্বাচন আইনগতভাবে ও বিধিবিধানগতভাবে সঠিক হয় এবং প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এভাবে একটি ভিসানীতি ঘোষণা করে অ্যাকশন নিচ্ছে। তারা বলছে বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অহিংস নির্বাচন হবে এবং এর জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, অঙ্গীকারবদ্ধ।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ভিসানীতি প্রয়োগের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় বিরোধী দলের সদস্যরা আছেন বলে উল্লেখ আছে। তিনি মনে করেন, নির্বাচন করতে দেব না, বিরোধী পক্ষের এমন ঘোষণা অবশ্যই গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের কতজন মার্কিন ভিসানীতির আওতায় পড়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সংখ্যাটি খুব বড় নয়। সরকারের কেউ যদি ভিসানীতির শিকার হন এবং তাতে যদি সরকারের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে তবে তারা অবশ্যই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলবেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //