প্রবীণদের ‘একাকিত্ব’ ঘুচবে কবে

তিলে তিলে যারা নিজ পরিবার গড়েছেন, সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে ঝরিয়েছেন ঘাম। সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি-কোথায় নেই তাদের অবদান! অথচ বার্ধক্যে এসে এর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য আর উপেক্ষার শিকার হতে হয় তাদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবীণদের কমন সমস্যা হলো-একাকিত্বে ভোগা। এমনই এক কঠিন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস।

প্রবীণ দিবসকে সামনে রেখে আলাপ করতে গেলে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর রমনা পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন করলেন সাবিহ উদ্দিন (ছদ্মনাম)। তিনি সরকারি উচ্চ পদে চাকরি করে অবসর নিয়েছেন অনেক বছর হলো। তার বয়স এখন নব্বই ছুঁইছুঁই। আক্ষেপ করে বলছিলেন, প্রবীণদের কী অবস্থা, তা দেখতে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার দরকার হবে না। আপনার আশপাশে তাকালেই দেখতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে আমার পরিচয়টাও দিতে চাইছি না, বুঝতে পারছেন!

সমাজের শ্রেণিভুক্ত সাবিহ উদ্দিনের এক ছেলে, এক মেয়ে। তারা উচ্চ শিক্ষা নিতে ইউরোপের একটি দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সে দেশেই থেকে গেছেন, বিয়ে করে পরিবার নিয়ে গেছেন। কিন্তু দেশেই থেকে গেছেন সাবিহ উদ্দিন ও তার স্ত্রী। সন্তানরা ভালো আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তারা মোবাইলে কল করে, অনলাইনে ভিডিও কল করে। কথা হয়, দেখাও হয় ভার্চুয়ালি। তারা বলে, ভালো আছে। আমরাও ভালো থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু এভাবে কী আর ভালো থাকা যায়!

এদিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর বসে গল্প করছিলেন তিন প্রবীণ । তারা সবাই মোটামুটি মধ্যবিত্ত বলা যায়। তাদের সঙ্গে কথা শুরু হলো গল্পের ছলে, ফাঁকে প্রবীণদের নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আসতে থাকে মিশ্র জবাব।

মেজবাহ উল ইসলাম (৬৫) বলছিলেন, আমরা আমাদের যৌবনের সেরা সময়, শ্রম এবং সকল উপার্জন বিনিয়োগ করেছি সন্তানদের জন্য, পরিবারের জন্য। তারা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নিজেদের সন্তান, পরিবার হয়েছে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে আমার মতো সব কিছু বিনিয়োগ করছে। কিন্তু তারপরও একটা মৌলিক পার্থক্য আছে দুই প্রজন্মের মধ্যে। আমরা বাবা-মায়ের সঙ্গে যৌথ পরিবারে থাকতাম এবং তাদের ও সন্তানদের প্রতি সমান যত্নবান হতাম। সন্তানদের ক্ষেত্রে দেখছি প্রায় তার উল্টোটা। আমার একার পরিবারে নয়, আমাদের সমাজেই এমন পরিবর্তনটা লক্ষ করছি।

এসব কথা যখন মেজবাহ সাহেব বলছিলেন, তখন পাশে বসে থাকা আনোয়ার হোসেন ও জিল্লুর রহমান মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। নিজের ভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা দাদা-দাদির সঙ্গে খেলা করে বড় হয়েছি। আর এখন নাতি-নাতনিরা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকায় আমরা বুড়োরা গল্প করছি, দেখতেই পাচ্ছেন। জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা বাবা-মাকে যেভাবে গুরুত্ব দিতাম, এখন সেভাবে উপেক্ষা করে সন্তানরা। এটা অনেক সময় যন্ত্রণা দেয়।

ষাটোর্ধ্ব রমিজ মিয়া এখনও রাজপথে রিকশা চালিয়ে নিজে উপার্জন করেন। তা দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করেন তিনি। বাসাবোতে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে বলেন, একটা মেয়ে আছে, বিয়ে দিয়েছি। সে স্বামীর সংসারে। আমি ও আমার স্ত্রী একটা বাসায় থাকি। এখান থেকে কাছেই, ছোট একটি বাসা। মেয়ে মাঝেমধ্যে আসে, খোঁজখবর নেয়। আমার ইনকাম দিয়ে আমার সংসার চলে। একটা ছেলে থাকলে হয়তো এই বয়সে এত কষ্ট করতে হতো না। বয়স্ক ভাতা পেলে হয়তো আরেকটু ভালো থাকতে পারতাম। জিনিসপত্রের যে দাম, অন্য কিছু ভাবার সময় কই!

সত্তরোর্ধ্ব আফসার গাজী পান-সিগারেট বিক্রি করেন রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীতে। তিনি বলেন, ছেলে আছে দুইটা। আলাদা থাকে বউ নিয়া। আমি একা থাকি। যা আয় হয়, তা দিয়ে চলতে হয়। ছেলেরা খোঁজখবর নেয়। এভাবেই চলছে জীবন। মরার আগ পর্যন্ত এভাবেই হয়তো চলতে হবে। কিন্তু সন্তানদের কত কষ্ট করে বড় করেছি, চিন্তা করলে কষ্ট লাগে।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

গ্রুমিং ফ্রিক্সের ডিপ্রেশন ও ট্রমা বিশেষজ্ঞ এবং সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর সামিয়া আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে আসা প্রবীণদের কমন সমস্যা হলো— একাকিত্বে ভোগা। এটা হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান সমস্যা। পরিবারের সঙ্গে থাকলেও সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন না। আবার পরিবার থেকে আলাদা থাকলে তো কথাই নাই। সবার সঙ্গে প্রবীণদের দূরত্ব তৈরি হয়। সেবা-যত্নটা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না অনেক সময়। তারা মনে করেন, তাদের উপার্জন না থাকায় গুরুত্বটা কমে গেছে।

তার মতে, মানুষের বয়স হলে অনেক সময় হীনম্মন্যতা ভোগে। নিজের অক্ষমতা মাথায় আসে, নিজের সফলতা-ব্যর্থতা, অবদানসহ নানা কিছু কিন্তু করতে থাকে। ভাবে, পরিবারের জন্য সব করলাম কিন্তু কী পেলাম? জীবনে কত যে স্বপ্ন বা আশা পূরণ হয়নি, তা অজান্তেই ভাবনায় আসে। নিজের বিসর্জন আর অর্জনের হিসাব মেলাতে থাকেন অনেকে। অবসর সময়ে অনেক কিছু ভাবার সময় পান তারা। এ ক্ষেত্রে নেগেটিভ বিষয়গুলো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। এখান থেকে ডিপ্রেশন কাজ করে।

প্রবীণদের ক্ষেত্রে 'জেনারেশন গ্যাপের' নতুন একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন সায়া আলম। তিনি বলেন, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সম্পর্কটা সেভাবে থাকে না, এটাও একটা বড় কারণ। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে আগের প্রজন্মের একটা মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আমাদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আমাদের বাবা-মায়েদের চিন্তা-ভাবনার একটা পার্থক্য রয়েছে। এখনকার জেনারেশনটা একটু অন্য রকম। তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক প্রভাব, অর্থনৈতিক প্রভাব, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনই এসব কারণে এখনকার প্রজন্মের সাথে আগের প্রজন্মের একটা গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। এই জেনারেশন গ্যাপ অনেক ক্ষেত্রে ক্লেশ তৈরি করছে। তা ছাড়া প্রবীণদের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার নানা সীমাবদ্ধতা তো আছেই।

শুধু ভাতাই কী যথেষ্ট?

দেশের ৫৮ লাখ ১০ হাজার নাগরিক বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। দেশের প্রবীণ এই নাগরিকরা মাত্র ৬০০ টাকা হারে এই সুবিধা পাচ্ছেন। ‘সিনিয়র সিটিজেন নীতিমালা’য় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ থাকলেও, ভাতা ছাড়া তাদের জন্য আর কোনও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি।

তবে ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর (রবিবার) আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের আগে শনিবার (৩০ সেপেটম্বর) সমাজসেবা অধিদপ্তর জানায়, পর্যায়ক্রমে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবীণবান্ধব অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করেন। এর আওতায় বর্তমানে প্রায় সব প্রবীণ নাগরিককে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। আগে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হতো। তা বাড়িয়ে বর্তমানে ৬০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ সিনিয়র সিটিজেন ছাড়াও হিজড়া, প্রতিবন্ধীরাও ভাতার আওতায় রয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, যাদের বয়স ৬০ বছর হয়েছে, তাদের অন্য ভাতা থেকে প্রবীণ নাগরিক হিসেবে ভাতার আওতায় নেওয়ার কাজ চলছে। সেই হিসেবে প্রায় সব সিনিয়র সিটিজেন ভাতারও আওতায় রয়েছেন। দেশের প্রবীণ নাগরিকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে কাজ করছে সরকার।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ। বর্তমানে এই সংখ্যা কমে এসেছে। প্রবীণদের সম্মান ও কল্যাণে সরকার ২০১৩ সালে ‘প্রবীণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করে। প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ কার্ড করার করার কথা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরেও তা সম্ভব হয়নি। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়।

কী আছে প্রবীণ নীতিমালায়

প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সমাজে বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা আছে। নীতিমালা অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্পদ, মর্যাদা, লিঙ্গনির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। এ ছাড়া আলাদা, বিনামূল্যে ও স্বল্প মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, সব ধরনের যানবাহনে আসন সংরক্ষণ, বিশেষ ছাড়ে টিকিট প্রদান এবং আলাদা টিকিট কাউন্টার স্থাপন, প্রবীণদের জন্য দিবা-যত্নকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এমনকি মৃত্যুর পর দাফনের দায়িত্বও পালন করবে রাষ্ট্র। অন্যদিকে, সিনিয়র সিটিজেনদের সম্পদ রক্ষাসহ সঞ্চয় প্রকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে সরকারের।  যদিও ভাতা ছাড়া এসব সুযোগ-সুবিধার কিছুই এখনও করা সম্ভব হয়নি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //