শরতে বর্ষার রূপ আর কবে দেখা গিয়েছিল

বর্ষা শেষ অনেক আগেই, চলছে শরৎ। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে তা বোঝার উপায় নেই। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় তিন দিন ধরে প্রবল বৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির তোড়ে রাজশাহী নগরীর সড়কে পানি জমেছিল। ময়মনসিংহে হয়েছে বৃষ্টির রেকর্ড।

বছরের এ সময়ে এমন বৃষ্টি কি খুবই অস্বাভাবিক? বাংলাদেশের আবহাওয়ার তথ্য বলছে, এ সময়ে এমন বৃষ্টি আগেও হয়েছে। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিও হয়েছে। প্রশ্ন হলো, অসময়ে এত বৃষ্টি কেন?

অসময়ে বৃষ্টির তিন কারণ

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রথমত, চলতি মাসের শুরুতে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে একই সময়ে দুইটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। নিম্নচাপ দুটি দ্রুত স্থলভাগে উঠে পড়ে। আরব সাগরেরটি মুম্বাই দিয়ে ও বঙ্গোপসাগরেরটি পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে স্থলভাগে উঠে যায়। পরে দুটি একত্র হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে রাজশাহীতে ঢোকে। তাই ওইদিন রাজশাহীতে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগরে এরই মধ্যে ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র বা ইন্ডিয়ান ওশেন ডাইপল-আইওডি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি সক্রিয় হলে সাগরের মাঝখানের অংশ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এতে জলীয় বাষ্প বেড়ে যায়। যা এক জোট হয়ে ভূখণ্ডের দিকে আসতে থাকে। গত দুই মাস ধরে আইওডি সক্রিয় থাকায় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প আসা বেড়ে গেছে। একই কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে জেট স্ট্রিম বা ঘূর্ণি বায়ু তরঙ্গ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওই বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প ও বাতাস বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসছে।ফলে এখানে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। আগস্টে চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিতে এবং সেপ্টেম্বরে ঢাকায় একই কারণে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছিল।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে মৌসুমি বায়ু বিদায় নিতে শুরু করেছে। মৌসুমি বায়ুর অগ্রভাগ এবং পশ্চাৎ ভাগে জলীয় বাষ্প এবং মেঘ বেশি থাকে। ফলে জুনের মাঝামাঝি সময়ে এটি যখন টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন প্রচুর বৃষ্টি হয়। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে যখন বাংলাদেশ ছেড়ে যায় তখনো প্রচুর বৃষ্টি ঝরায়। সাধারণত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তা বাংলাদেশ ভূখণ্ড ছেড়ে যায়। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা নিম্নচাপের কারণে এটি এবার শেষ সময়ে এসে আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যে কারণে বাংলাদেশের ভেতরে প্রচুর জলীয় বাষ্পসহ মেঘ জড়ো হয়ে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে।

এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল বলেন, দুটি স্থল নিম্নচাপ একত্র হয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠায় মূলত বৃষ্টি বেড়ে গেছে। এর ফলে ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর থেকে আসা মেঘ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর জেট স্টিমের কারণে তা আরও শক্তি অর্জন করছে। যে কারণে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। 

বর্ষণমুখর অক্টোবর কি এবারই প্রথম?

বাংলাদেশের আবহাওয়ার তথ্য বলছে, দেশের ইতিহাসে অক্টোবর মাসে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে অন্তত ৯ বার। দেখা গেছে, এই ৯ বারের মধ্যে তিনবারই সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ময়মনসিংহে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় ময়মনসিংহে ৩৭৮ মিলিমিটার। দেশের ইতিহাসে অক্টোবরে মাসে রেকর্ড হওয়া বৃষ্টির দিক থেকে এই বৃষ্টি তৃতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর ময়মনসিংহে বৃষ্টি হয়েছিল ৩৮১ মিলিমিটার। দেখা গেছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বড়জোর ১০ তারিখের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি হয়।

এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, মৌসুমি বায়ু অক্টোবরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই মোটামুটি বিদায় নেওয়ার অবস্থায় চলে যায়। বৃষ্টির দাপট তাই এই সময়ে বাড়ে।

আবার অক্টোবর ও নভেম্বর ‘ঘূর্ণিঝড়প্রবণ’ মাস হিসেবে পরিচিত। দেশে সাধারণত মৌসুমি বায়ু আসার আগে এবং চলে যাওয়ার পর ঘূর্ণিঝড় হয়। মৌসুমি বায়ু আসার আগে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হয়। আবার চলে যাওয়ার পর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৬২০টি ঘূর্ণিঝড় ও অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। আর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে ৯৪১টি। ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অক্টোবর মাসে হয়েছে ২৫৫টি, নভেম্বরে ২১৯ ও ডিসেম্বরে ১০৫টি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অক্টোবরে ৪২টি, নভেম্বরে ৭৪ ও ডিসেম্বরে ২৮টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর চলতি অক্টোবর মাসের যে পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, দু-তিনটি লঘুচাপ ও একটি নিম্নচাপ হতে পারে। সেই নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এবারের বৃষ্টি সাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপ এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবেই হয়েছে।

শীতকালীন কৃষিতে প্রভাব

বাজারে এখন কিছু কিছু শীতকালীন শাকসবজি আসা শুরু হয়েছে। এগুলো বাস্তবে শীতের সবজির বৈশিষ্ট্য বহন করে না। এগুলোকে কৃষিবিদেরা বলে থাকেন অফ সিজন ভ্যারাইটি। শীতকালীন শাকসবজির আবাদ শুরু হয় সাধারণত মধ্য অক্টোবরে।

কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, যারা শীতকালীন শাকসবজির জন্য খেত প্রস্তুত করছেন, তাদের ক্ষতি হতে পারে এই বৃষ্টিতে। এ ছাড়া এখন ধান আছে খেতে, যেসব ধানে ফুল এসে গেছে, সেসব ধানের হয়তো খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তবে টানা বর্ষণে বন্যার সৃষ্টি হলে আমনের ক্ষতি রোধ করা যাবে না। শীতের ফলের মধ্যে পেঁপে এবং কলা অন্যতম। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে এই দুই ফলেরও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

বৃষ্টি কমতে পারে শনিবার

রাজধানীতে আগের দিন শুরু হওয়া বৃষ্টি রাতে কিছুটা কমে এলেও সকাল থেকে আবারও চলে থেমে থেমে। দুপুরে নামে মুষলধারে। আজ শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সারা দিনই এরকম বৃষ্টি চলতে পারে। তবে আগামীকাল শনিবার কমে আসতে পারে এই বৃষ্টি—জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ এবং এখনও মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় এর প্রভাবে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। আগামীকাল শনিবার (৭ অক্টোবর) নাগাদ এই বৃষ্টি কমে আসতে পারে বলে তিনি জানান।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থানরত লঘুচাপটি বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষ পূর্ব উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।

আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //