অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ: দেশ ছাড়তে চান তরুণরা

‘নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিদেশ যেতে চাই। কেননা দেশে সফল হতে হলে মেধার চেয়ে বেশি মূল্যায়ন পায় লবিং, নেপোটিজম। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আরও অনেক বেশি। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, বাইরেও নিরাপত্তার অভাব। নারীরা চাকরি করবে, উদ্যোক্তা হবে, ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করবে, এসব সিদ্ধান্তের কথা যখন পরিবারকে জানানো হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচকভাবে নেওয়া হয়। তবে দেশ ছেড়ে উন্নত বিশ্বে স্থায়ী হয়ে একই কাজগুলো করলে পরিবারের কোনো আপত্তি নেই। তাই দেশ ছেড়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবছি।’ নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাবেয়া আক্তার রুমপি।

দেশের অর্থনীতির খারাপ সময় যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শিগগিরই এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এমন কোনো আশাও দেখছেন না তরুণরা। চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় দেশ নিয়ে ব্যাপক হতাশার জন্ম নিয়েছে এ প্রজন্মের মধ্যে। আবার উদ্যোক্তা হতে হলে পণ্যের মূল খরচের চেয়ে বেশি চলে যায় ঘুষ, ভাড়া প্রভৃতি অনুৎপাদনশীল খাতেই। এ ছাড়া হয়রানি এবং নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। তাই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে এড়িয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে জীবনযাপনের জন্য অনেকেই বিদেশ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই নতুন আবেদনকারীদের দীর্ঘ সারি।

এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের প্রায় অর্ধেকই বা ৪২ শতাংশ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। অনিশ্চিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দক্ষতা  অনুযায়ী চাকরির বাজার তৈরি না হওয়া, গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগের অভাব এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শঙ্কার কারণেই তাদের এ আকাঙ্ক্ষা। তবে বিদেশ যাওয়ার পর যদি দেখেন এসব সংকট সমাধান হয়েছে তাহলে ৮৫ শতাংশই আবার দেশে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ শীর্ষক যৌথ সমীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ সমাজ একটি দেশের সম্পদ। যে দেশের তরুণরা স্বপ্ন দেখতে পারে, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুর্বার সাহস জোগায়; সে দেশ উন্নতির সোপানে দ্রুত অগ্রসর হতে সক্ষম। কিন্তু তরুণদের স্বপ্ন ও উদ্যমকে অবহেলা করে যদি সামনে এগোনোর চিন্তা করা হয়, তাহলে সে অগ্রযাত্রা এক সময় ভেস্তে যায়। তাই তরুণ জনসম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য তরুণরা যেন দেশের উন্নতিতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পারে, সে রকম পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) গবেষণা পরিচালক ড. এম সানজীব হোসেন বলেন, ‘আমি তরুণদের নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। এ দেশের তরুণদের মধ্যে যে আশার শিখা দেখতে পেয়েছি তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এখন এটা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব আমাদের রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের।’ 

বাংলাদেশের যুব সমাজের অবস্থান, সমসাময়িক ভাবনা ও প্রত্যাশা জানতে প্রতি পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সমীক্ষা পরিচালনা করে বিওয়াইএলসি। জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিপ্রয়াণ নিয়ে এ জরিপ করা হয়। 

ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভের প্রধান গবেষক হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যাতে তরুণদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে, সে জন্য নির্বাচনকে সামনে রেখে এ জরিপটি পরিচালিত হয়। সমীক্ষার ফলাফলে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ উভয়ই উঠে এসেছে। ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে তারা নিরাপদ বোধ করেন না। তরুণদের মতপ্রকাশের জন্য আরও নিরাপদ আবহ তৈরি করা যে কতটা জরুরি এ তথ্য তাই জানান দেয়।’

দেশের আট বিভাগের ৫ হাজার ৬০৯ তরুণ-তরুণীর মাঝে পরিচালিত এবারের জরিপে দেখা যায়, ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশই দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে সামনে এনেছেন। ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ আবার মনে করেন, তাদের যে দক্ষতা রয়েছে দেশে সে অনুযায়ী চাকরি নেই। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই মনে করেন ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন দেশে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ কম। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে দেশ ছাড়তে চাইছেন ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী।

জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন বর্তমানে দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা নেই। অপরদিকে ৬৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন গত পাঁচ বছরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়াও ২৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস পাচ্ছে, যা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে।

দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যায় সম্প্রতি স্নাতক শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ওবায়দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে সেক্টরভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই নগণ্য। অধিকাংশ সেক্টরে মেধার মূল্যায়ন হয় না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের শেখা এবং জানার অন্যতম প্রধান মাধ্যম গবেষণা। অথচ আমাদের দেশে এর জন্য ফান্ডিং নেই বললেই চলে। গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির বাজারও সংকীর্ণ।’

বিওয়াইএলসি জরিপে দেখা যায়, জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণই ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছেন। শিক্ষার মানোন্নয়নেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন তরুণরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশই মনে করেন এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের মান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন পাঠ্যক্রমে নেতৃত্বচর্চা ও সফট স্কিল উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ যুক্ত করে শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব।

হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম বলেন, ‘তরুণরা বিদেশ যাওয়ার কারণ হিসেবে নিরাপত্তা, পেশাগত ও আর্থিক উন্নয়নকে বিবেচনায় নিয়েছেন। গণতন্ত্রের যে অবনতি, তাও তারা বিবেচনা করেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সার্বিকভাবে কাজ ও প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্টের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশের বাইরে যেতে চান তরুণরা।’

তরুণদের শুধু ভবিষ্যতের কাণ্ডারি হিসেবে দেখলেই চলবে না, বরং সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী কাজে যুক্ত করতে হবে বলে মনে করেন বিওয়াইএলসির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সভাপতি ইজাজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যুবকদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তাদের মতামত কেবল জাতীয় নীতিমালায় যুক্ত করলেই হবে না; রাজনীতি, ব্যবসা, বেসামরিক খাত এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বচর্চার ক্ষেত্রও তৈরি করে দিতে হবে।’

দেশ নিয়ে তরুণদের যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি অনেক আশাও রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। কেননা গবেষণায় উঠে এসেছে প্রায় ৬০ ভাগ তরুণ-তরুণী দেশেই থাকতে চান। ৭০ ভাগের বেশি মনে করেন দেশেই তার ব্যক্তিগত উন্নতি হবে। প্রায় ৭০ ভাগ সামনের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। হতাশার জায়গা আছে। তবে আশার জায়গাও আছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা আছে। তারা ভালো থাকতে চায়, ভালো পরিবেশ চায়। বাংলাদেশে এর যথেষ্ট অভাব। এখন আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ফলে বিদেশে যেতে চাওয়ার অনেক কারণও আছে। এটা সব সময় যে খারাপ তাও নয়। আবার এর মাধ্যমে মেধা পাচারও হয়। কিন্তু যেখানেই তারা থাকুক দেশের জন্য কাজ করলে তা ইতিবাচক। এ জন্য অবশ্য তরুণদের দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদিও সেটা নেই, যা উন্নত দেশে রয়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //