পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে স্থানীয় চার নেতার বক্তব্য

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংঘাতের অবসানে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক এই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। সাধারণ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত চুক্তিটি ২৫ বছর পেরিয়ে ২৬ বছরে পা দিয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চার নেতার তিন জন প্রায় একই মতামত দিলেও ভিন্ন মত দিয়েছেন একজন। এ নিয়ে দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যমের কথা হয়, রাঙ্গামাটির আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরীর সঙ্গে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা আজ শনিবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি বক্তব্য রেখেছেন। সেই আলোচনা সভাতেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেন।

সন্তু লারমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দিবস উপলক্ষে শনিবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেন, দেশের সরকার ও শাসকগোষ্ঠীকেই এ চুক্তি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।

তিনি বলেন, দেশের সরকার ও শাসকগোষ্ঠী এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট হতে হবে। যদিও সেই আশা বাস্তবতায় রূপ নেবে না। তবুও সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকটাকে বজায় রাখতে চাই। তিনি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন।

দীপংকর তালুকদার

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি গণমাধ্যমকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা নিয়ে শুধু আমরা নই, এখানে তিনটা সরকার অর্থাৎ এরশাদ সরকার, বিএনপি সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার— সবাই চেষ্টা করেছে বিরাজমান সমস্যার সমাধানের জন্য। আমরা ১৯৯৭ সালে একটা চুক্তি করতে পেরেছি- যেটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে পরিচিত। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর হয়ে গেছে। এ চুক্তির জন্য জনসংহতি সমিতি নিজেদের একক কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। আমরাও পারি না। এর সঙ্গে জনগণের বড় সম্পৃক্ততা আছে। এ চুক্তি সম্পাদনের পেছনে গণমাধ্যমেরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।

দীপংকর তালুকদার বলেন, বিগত ২৬ বছরে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াটা খুবই দুঃখের ও কষ্টের। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেহেতু এটার সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সেজন্য এ চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াটাও আমার জন্য একটা যন্ত্রণার। চুক্তি স্বাক্ষরকারী একটা পক্ষ বলবে যে, সরকারের আন্তরিকতা নাই, এই নাই, সেই নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের কথা তারা বলুক। আমি বলছি যে, কেনও বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ফলে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে আগের তুলনায় অনেক বেশি কনফিডেন্স তৈরি হয়েছে। পাহাড়িরা এখন আর বলে না- আবার তাদের পাহাড়ে যেতে হবে। না খেয়ে মরতে হবে। তারা এখন বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। পাহাড়িদের এখন গাড়ি কেনার সক্ষমতা হয়েছে। ৯৮ সালে লংঘদুতে যারা অভ্যন্তরীণভ উদ্বাস্তু হয়েছিল, তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা এখন বলছে, এখানেই থাকবে। এই যে সাহস ও কনফিডেন্স, সেটা পার্বত্য চুক্তির ফলেই হয়েছে।

দীপংকর তালুকদার আরও বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের বড় সমস্যা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। এখানে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো নিত্য টহল দিচ্ছে বলে আমরা ভালো আছি। শতভাগ ভালো আছি সেটা বলবো না। কিন্তু ভালো যতখানি আছি, সেটা সেনাবাহিনীর কারণেই আছি। যেকোনও সময়ের চেয়ে ভালো আছি। চাঁদাবাজি কিছুটা কমেছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো অনেকটাই কোনঠাসা অবস্থায় আছে। আগের মতো অবস্থায় তারা নেই। বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

সুপ্রদীপ চাকমা

সাবেক কূটনীতিক ও বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা গণমাধ্যমকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে চিন্তা-চেতনা কাজ করছে, সেটা সম্পর্কে আমরা পাহাড়ি-বাঙালি সবাই জানি। তিনি দেশের অন্যান্য এলাকার জন্য যা করছেন, তার চেয়ে বেশি করছেন এই এলাকার জন্য। সরকার এত বেশি দিতে চায় যে, নানা কারণে আমরা তা নিতে পারছি না। আমাদের নেওয়ার যোগ্যতা নেই। সীমান্ত সড়কসহ পাহাড়ের ঢালে ঢালে সড়কের যে উন্নয়ন হয়েছে, অন্যান্য খাতে যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে, এ অঞ্চলের মানুষ কখনই এত উন্নয়ন হবে ভাবেননি। এটা ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির ফলেই হয়েছে। আর এখন এ অঞ্চলের মানুষ চুক্তির কী হলো না হলো সেটা নিয়ে ভাবেন না।

তিনি বলেন, একটা অঞ্চলের জন্য কানেকটিভিটি যে কী প্রয়োজন, সেটা আমরা বুঝি। এখন সেই কানেকটিভিটি বা যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। আরও হবে। এতে এ অঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নতি হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, কারও কোনও চিন্তা করার কারণ নেই যে, এটা বাস্তবায়ন হয়েছে ওটা হয়নি। সবক্ষেত্রেই দুটো পক্ষ থাকে। দুপক্ষই দুধরনের কথা বলেন। সরকারের আন্তরিকতার সঙ্গে অপর পক্ষকেও আন্তরিক হতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।  

অংসুই প্রু চৌধুরী

শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তিতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে একটা অশান্ত পরিস্থিতি ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছেন। এর ফলে এখানে যে অশান্ত পরিস্থিতি ছিল- পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে বিভেদ ছিল, সম্প্রীতি ছিল না, সেটা এখন আর নেই। পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা পাহাড়ি-বাঙালি পরস্পর সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করছি। পরস্পরের মধ্যে অনাস্থা-অবিশ্বাস কমে এসেছে। আগের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। শান্তিচুক্তির কারণে পার্বত্য মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়েছে। জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ সৃষ্টি হয়েছে। পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্যই এসব করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় জেলা পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ল্যান্ডসহ ৩০টি বিভাগ ও দপ্তরকে সরকার আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি ও সমন্বয় করে সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করছি।

পার্বত্য এলাকায় সহিংসতা ও হানাহানির বিষয়ে অংসুই প্রু চৌধুরী আরও বলেন, রাজনৈতিক দলের একটি উদ্দেশ্য থাকবে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলো যে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, সেটাতে মনে হয় না তাদের ভালো কোনও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে। আমরা দেখছি, তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, নিজেদের মধ্যে সংঘাত প্রাধান্য পাচ্ছে। তারা যদি মানুষের অধিকারের জন্য সংগঠন করে থাকে, তাহলে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, অপহরণ ও চাঁদাবাজি কেন? গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপ কেন? আমরা বাংলাদেশে বসবাস করছি। গণতান্ত্রিক একটা দেশ। গণতন্ত্র চর্চার এখন পরিবেশও বিদ্যমান। কারও কোনও দাবি থাকলে সেটা বলতে পারেন। রাজপথে কিংবা সামনাসামনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //