শ্রম আইনের সংশোধনী বিলে সায় দেননি রাষ্ট্রপতি

জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল–২০২৩’এ সই না করে তা পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পাস হওয়া বিলের একটি দফার কারণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, এমন বার্তা পেয়ে বিলটি ফেরত পাঠানো হয়। ফলে ওই বিল এখনই আইনে পরিণত হচ্ছে না।

চলতি একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশনে তড়িঘড়ি করে শ্রম আইনের সংশোধনী বিলটি পাস করা হয়। গত ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল জাতীয় সংসদে তোলা হয়। বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তিন দিন সময় দিয়ে তা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ২ নভেম্বর বিলটি সংসদে পাস হয়। বিলে সম্মতির জন্য গত ৮ নভেম্বর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়।

জানা গেছে, বিলটিতে সই না করে গত ২০ নভেম্বর তা সংসদে ফেরত পাঠান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ২২ নভেম্বর সংসদ সচিবালয় এ-সংক্রান্ত বার্তাসহ একটি বুলেটিন প্রকাশ করে। তাতে রাষ্ট্রপতির বার্তা তুলে ধরা হয়। ওই বার্তায় বলা হয়, এই বিলের দফা-৪৫ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। কাজেই উক্ত দফা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানো হলো।

সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সপ্তম সংসদে পাস হওয়া একটি বিল সই না করে সংসদে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে দফাটি পুনর্বিবেচনা করতে বলা হয়েছে সেটি বে–আইনি ধর্মঘট বা লকআউটের দণ্ডসংক্রান্ত। এটি মূল আইনের ২৯৪ ধারা। এই ধারার ১ উপধারায় শ্রমিকদের বে–আইনি ধর্মঘটের দণ্ডের কথা বলা আছে। আর ২ উপধারায় মালিক পক্ষের বে–আইনি লকআউটের দণ্ডের বিধান আছে। উভয় ক্ষেত্রে দণ্ড একই। যেভাবে বিলটি পাস হয়েছে, তাতে শুধু শ্রমিকদের বে–আইনি ধর্মঘটের জরিমানা ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২০ হাজার টাকা হয়েছে। অন্যদিকে মালিকদের দণ্ড আগের মতোই রয়ে গেছে। কারণ, উপধারা–২ সংশোধিত হয়নি। এ ছাড়া সংশোধনীতে ধারা উল্লেখ করা হয়েছে ২৯১, প্রকৃতপক্ষে এটি হওয়ার কথা ২৯৪। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণে বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শ্রম অনুবিভাগ) মো. তৌফিকুল আরিফ গণমাধ্যমকে বলেন, তারা এখনো বিলটির কপি হাতে পাননি। তারা উভয় ক্ষেত্রে দণ্ড বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে কোনো এক ধাপে করণিক ভুল হয়ে থাকতে পারে। বিলের কপি পাওয়ার পর বিষয়টি বলা যাবে।

জাতীয় সংসদে কোনো বিল পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিলে তখন তা আইনে পরিণত হয়। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো বিল পেশ করার ১৫ দিনের মধ্যে তিনি তাতে সম্মতি দেবেন অথবা অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তার কোনো বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করে একটি বার্তাসহ বিলটি সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন।

সাধারণত রাষ্ট্রপতিকে কোনো বিল সংসদ ফেরত পাঠাতে দেখা যায় না। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সপ্তম সংসদে পাস হওয়া একটি বিল সই না করে সংসদে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।

কোনো নতুন আইন প্রণয়ন বা আইনের সংশোধনী আনতে গেলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। প্রথমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রস্তাব তৈরি করে। সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের (মতামত) জন্য পাঠানো হয়। পরে মন্ত্রিসভায় আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। এরপর তা জাতীয় সংসদে তোলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। এরপর বিলটি পরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরপর তা পাসের জন্য সংসদে তোলা হয়। সেখানে সংসদ সদস্যরা বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব দেন এবং আলোচনা করেন। তারপর সেটি কণ্ঠভোটে জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই লম্বা প্রক্রিয়ায় শ্রম আইনের সংশোধনী বিলের ওই ত্রুটি বা বিভ্রান্তি ধরা পড়েনি।

জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিলটি তামাদি হয়ে যাবে। আগামী দ্বাদশ সংসদে আবার নতুন করে বিল উত্থাপন করতে হবে।

এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী আনার সময়ও এ ধরনের বিষয় দেখা গেছে। তবে তখন রাষ্ট্রপতি বিল ফেরত পাঠাননি। আগে এই আইন অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন আগে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এবং কৃষিঋণ ও বিভিন্ন সেবা খাতের বিল পরিশোধের বিধান ছিল। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে এখানে সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু সংশোধনীটি হয়েছিল আংশিক। তখন শুধু ব্যাংকঋণ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত পরিশোধের সুযোগ রেখে সংশোধনী আনা হয়েছিল। কৃষিঋণ ও বিলখেলাপিদের জন্য আগের বিধানই রয়ে গিয়েছিল। পরে গত জুলাইয়ে এই অংশটি সংশোধন করে সামঞ্জস্য আনা হয়।

ট্রেড ইউনিয়ন গঠনপ্রক্রিয়া সহজ করা, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) শ্রম আইন কার্যকর করাসহ শ্রম অধিকারের কয়েকটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছিল। মূলত সে কারণেই সরকার চলতি মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে আবার শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মেয়াদে সংশোধনী কার্যকর হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //