আইন-শৃঙ্খলার অবনতি

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সার্বিকভাবে অবনতি হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বিএনপির হরতাল-অবরোধ ঘিরে যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডসহ সহিংসতার ঘটনা তো ঘটছেই। অন্যদিকে নির্বাচনী সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী বেড়ে গেছে চুরি-ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনা। ভোট গ্রহণের আগের দিনগুলোতে যেমন সহিংসতা আরও বাড়তে পারে, একই সঙ্গে ভোটে না যাওয়া দলগুলোও ভোট ভণ্ডুলের প্রচেষ্টা নিতে পারে। ফলে ভোটের পরের দিনগুলোর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল।

তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র, প্রার্থী, ভোটার, প্রিসাইডিং অফিসার ও রিটার্নিং অফিসারসহ প্রত্যেককে নিরাপত্তা দিতে ইতোমধ্যে নির্বাচনী ছক তৈরি করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে মাঠে মোতায়েন করা রয়েছে সাড়ে ৭ লাখের বেশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। যা গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এক লাখ ৩০ হাজার বেশি। গত ২৯ ডিসেম্বর মাঠে নেমেছে বিজিবি, এরপর ৩ জানুয়ারি সেনাবাহিনী। তাই আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি শান্ত থাকবে বলে আশা করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।

হরতাল-অবরোধ ঘিরে সহিংসতা

বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যে বাসে আগুন দেওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে রেলও। গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দেওয়া আগুনে চারজন পুড়ে মারা যান। এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে ভাওয়াল গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে রাখে দুর্বৃত্তরা। যাতে একজন আহত ও একজন নিহত হন। এর আগে গত ১৬ নভেম্বর রাতে টাঙ্গাইল স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের কোচে আগুন দেওয়া হয়। ২২ নভেম্বর রাতে সিলেট রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি কোচে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

নির্বাচনী সহিংসতা

নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে মাদারীপুর-৩ আসনটি বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে। কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মিছিলে ককটেল হামলা হয়। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দা এস্কান্দার খাঁ নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাটি আলোচিত হয়েছে নির্বাচনী সহিংসতা হিসেবে। 

নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর মাদারীপুর, ফরিদপুর, পিরোজপুর, নওগাঁ, লালমনিরহাট, মানিকগঞ্জ, ঝিনাইদহ, জামালপুর, পটুয়াখালী, গাজীপুর, কক্সবাজার, বাগেরহাট, বরিশাল, চট্টগ্রাম, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হামলার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতা হয়েছে রাজধানীতেও। 

গত ৩০ নভেম্বর রাজধানীরে সেন্ট্রাল রোডে ঢাকা-১০ আসনের নৌকার প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদের নির্বাচনী প্রচারে তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় অন্তত ১২ জন আহত হন।

বেড়ে গেছে চুরি ছিনতাই

নির্বাচন নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগে বেড়ে গেছে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর অনেক এলাকাই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে এবং গণছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। 

বাসাবাড়িতে চুরির ঘটনাটিও সম্প্রতি বেড়ে গেছে উদ্বেগজনক হারে। আগে এ ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটতে শোনা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা নিত্যনৈমিত্তিক ও ধারাবাহিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ে গভীর রাতে গরুচোর পড়েছে বলে চিৎকার শোনা গেলেও দীর্ঘসময় পর সেসব ঘটনারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে এখন।

শঙ্কা সবার মধ্যে 

গত ৩০ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সকল আন্দোলনে বিএনপি ব্যর্থ, তারা স্বাভাবিক আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে নাশকতার দিকে গেছে। এখন আমরা খবর পাচ্ছি, লন্ডন থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, গুপ্ত হত্যার দিকে তারা যাবে। এ নির্বাচনকে ঘিরে হয়তো দেখা যাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা বা প্রার্থীকে লাশ বানানোর চক্রান্ত তাদের আছে। আমরা সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’

গত ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দিকে সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে আছে। আমরা যদি এই নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য করতে না পারি; তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সকল বিষয়; বিশেষ করে আর্থিক, সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকবে।’

সহিংসতা নিয়ে যা বলছে ইসি

নির্বাচনের আগে সহিংসতায় বিভিন্ন স্থানে হতাহতের খবর এলেও ‘খুব বেশি ঘটনা ঘটেনি’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, ‘শাসক দলের প্রত্যেকটা নির্বাচনী মাঠে আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রার্থীদের সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে আমরা সভা করেছি। তাদের কাছ থেকে আমরা খুব বেশি অভিযোগ পাইনি। প্রশাসনের ওপর তাদের আস্থা রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা বা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, পোস্টার ছেঁড়া—এগুলো হয়েছে। কিন্তু মোটা দাগে খুব বেশি ঘটনা হয়েছে বলে মনে হয় না। সহিংসতা একেবারেই হয়নি সে কথাটা বলছি না।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যা বলছে

ভোটের দিনকে কেন্দ্র করে নাশকতার আশঙ্কা আছে কিনা—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘নাশকতার বিষয়ে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সজাগ রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীও কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আগাম সতর্কতা নেই। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে তেমন কোনো খবর আসেনি।’

‘বিএনপি গুপ্ত হত্যা চালাতে পারে’ বলে অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী এ বিষয়ে সজাগ রয়েছে। এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে গেলে কিংবা ঘটনার পূর্বেই আমরা ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

ইতোমধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে, পরে এবং নির্বাচনের দিন যে কোনো নাশকতা ঠেকাতে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তৎপর থাকবে। কোনো নাশকতা কিংবা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে বিজিবি কঠোর অবস্থানে থাকবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //