কান্তজীউ মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদ তৈরি করেছিলেন তারা

দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তনগর গ্রাম। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মৃতপ্রায় ঢেপা নদী। এ নদীর পশ্চিম তীরেই বিখ্যাত কান্তজীউ মন্দির অবস্থিত। প্রায় পনেরো হাজার টেরাকোটার ফলকে মোড়ানো এ মন্দিরটি দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর একটি। দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ছাড়াও কান্তজীউ মন্দির স্বকীয় আরেকটি কারণে। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি মসজিদ তৈরির ইতিহাস। কিছুটা চমকপ্রদ হলেও সত্যিই এমনটি ঘটেছে, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। ১৭০৪ সালে দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ রায় পারস্য থেকে কারিগর এনে কান্তজীউ মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

পারস্য থেকে আসা এ কারিগররা ছিলেন মুসলমান। তাদের বসবাসের জন্য মন্দিরের পাশে অস্থায়ীভাবে ঘর তৈরি করা হয়েছিল। তখনো এ গ্রামের নিকটবর্তী কোনো জনপদে মসজিদ ছিল না। ফলে নির্মাণের কাজ চলাকালে কারিগররা নামাজের সময় অস্থায়ী ঘরে কিংবা নির্মাণাধীন মন্দিরের আশপাশের খোলা জায়গায় নামাজ পড়তেন। 

পারস্য থেকে আসা কারিগরদের দলটির সর্দার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ওরফে কালুয়া তাদের এ কষ্টকর পরিস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করে রাজার কাছে একটি মসজিদ তৈরির আবেদন করেন। 

স্থানীয় প্রকাশক সেলিম রেজা কর্তৃক সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ ও কান্তজীউ মন্দির’ শীর্ষক বই থেকে জানা যাচ্ছে, ‘মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ওরফে কালুয়ার মসজিদ তৈরির আবেদনটি মহারাজ প্রাণনাথ রায় সবিনয়ে গ্রহণ করেন। তাদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ ও স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কান্তজীউ মন্দির থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে বর্তমান নয়াবাদ গ্রামে ১.১৫ বিঘা জমি দান করেন তিনি। 

মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদ নির্মাণের কাজ সমানভাবে চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। কারিগররা মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিতে থাকেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে রাজা প্রাণনাথ রায় ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার পোষ্যপুত্র রামনাথ রায়ের তত্ত্বাবধানে ১৭৫২ সালে মন্দির ও মসজিদের কাজ শেষ হয়।’

‘নয়াবাদ মসজিদ’-এর নামের উৎপত্তি নিয়ে স্থানীয় কিংবদন্তি হলো, ‘মন্দির ও মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষে বেশিরভাগ কারিগর নিজ দেশে ফিরে যান। কিন্তু তাদের সর্দার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ওরফে কালুয়াসহ কয়েকজন ফিরে যাননি। রাজা প্রাণনাথ রায়ের কাছ থেকে পাওয়া কিছু জমিতে তারা চাষাবাদ করতে শুরু করেন। ইতিপূর্বে সেই সব জমিতে কখনো ফসলের আবাদ হয়নি, তাদের মাধ্যমে সেবারই প্রথম আবাদ হয়। এসব জমিতে নতুন আবাদ হয়েছে বলে স্থানীয় ভাষায় পুরো গ্রামটি ‘নয়াবাদ’ নামে পরিচিতি পায়। গ্রামের নামকরণের প্রভাবে মসজিদটিও ‘নয়াবাদ মসজিদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর কারিগররা গ্রামের যে অংশে বসবাস করতেন সেটি ‘মিস্ত্রী পাড়া’ নামে পরিচিত হয়। 

ঠিক কত সাল থেকে নয়াবাদ মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু এবং শেষ হয় তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে মন্দির তৈরির সময়কাল, অর্থাৎ ১৭০৪ থেকে ১৭৫২ সালের মধ্যেই মসজিদের নির্মাণ কাজও শেষ হয় বলে ধারণা করা হয়।

তিন গম্বুজ ও চারটি মিনার বিশিষ্ট আয়তাকার এই মসজিদের বাইরের দিক থেকে এর দৈর্ঘ্য ১২.৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫.৫ মিটার। এর ভেতরে দুটি সারিতে প্রায় চল্লিশজন মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদের বাইরের দিকে পোড়ামাটির তৈরি ফুল ও লতার নানা নকশা চোখে পড়ে। তবে বহু জায়গায় নকশাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

মসজিদের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে সহকারী ইমাম মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, মসজিদের সংস্কারের কাজ সরকার করে থাকে। তবে এখানে সরকার নিযুক্ত কোনো কর্মচারী নেই। মসজিদের অন্যান্য ব্যয় কমিটির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নির্বাহ করে থাকেন। এখানে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার টাকা আদায় করা হয় না। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত পর্যটক দীপঙ্কর সরকার জানালেন, আমি শুধু কান্তজীউ মন্দির দেখতে আসিনি, অর্থাৎ মন্দিরে এলাম পুজো দিলাম বিষয়টি এমন নয়। এখানে মন্দির কেন্দ্রিক যত স্থাপত্য আছে সবগুলোই দেখার ইচ্ছে আছে। নয়াবাদ মসজিদের প্রচার সে অর্থে একটু কম। তবে মসজিদ ও মন্দিরটি কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই সম্পর্কিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //