পশুর চামড়ার দাম বৃত্তান্ত

এবার কোরবানির পশুর ক্রয়মূল্য কেমন হবে, দেশের কোন প্রান্তের সীমান্ত পেরিয়ে গরু ঢুকছে, কোন হাটে উঠবে সেটা-তা নিয়ে পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে ঝড় বইতে শুরু করেছে আগেই। পশুর চামড়ার মূল্য কত হতে পারে সে নিয়েও চলছে নানা হিসেবনিকেশ। তবে একদা আলোচনার টেবিলের উপাদেয় বস্তুটির নাম এখন কেউ আর তেমন মুখে আনতে চান না বললেই চলে। গত এক দশকে কাঁচা চামড়ার মূল্য যেভাবে হু-হু করে তলানিতে এসে ঠেকছে তাতে মহল্লার আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর সবজান্তা চাচাটিও আর আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না।

দেশে গত এক দশকে চামড়ার জুতা থেকে শুরু করে সবধরনের পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও বিস্ময়করভাবে কাঁচা চামড়ার দাম দশ বছর আগের তুলনায় অর্ধেকের বেশিতে নেমে এসেছে। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অথচ আজ থেকে দশ বছর আগে ২০১৩ সালে ঢাকায় এরকম গরুর চামড়া ৮৫ থেকে ৯০ টাকা আর খাসির চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর ফলে সেবার কোরবানির পশুর চামড়ার বেশ ভালো দাম পাওয়া গিয়েছিল, যার সুফল পেয়েছিলেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। এরপর ২০১৪ সালে চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন চামড়ার দাম ২০১৩ সালের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭০ থেকে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বাস্তবে আরও বেশি দামে বিক্রি হয়েছিল। সেবার পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়া বিক্রি হয় ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। এরপর থেকে চামড়ার দাম কমতে কমতে ২০১৯ সালে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে অনেকেই চামড়া ফেলে দিয়েছিলেন বা মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলেন।

শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘স্থানীয় ট্যানারিগুলো বর্তমান বৈশ্বিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না। মূলত সাভার চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) না থাকার কারণেই স্থানীয় ট্যানারিগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না।’ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানীয় ট্যানারি কোম্পানিগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় নিজেদের কাঁচামাল ব্যবহার না করে বিদেশি মুদ্রায় বিপুল ব্যয় করতে হয়।

বিডা বলছে, ‘দেশীয় কোম্পানি এবং চামড়াশিল্প নগরীর সিইটিপি না থাকায় তাদের কাছ থেকে কাঁচামাল কিনছে না রপ্তানিকারকেরা। ফলে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ব্যয়ের পাশাপাশি রপ্তানি সম্ভাবনাও কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ’।

শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগরী প্রকল্প হাতে নেয়। ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে ১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরিবেশ দূষণ রোধ করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত কমপ্লায়েন্ট চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল সরকার। এত টাকা খরচ হলেও পরিবেশ দূষণ বন্ধে কমন ক্রোম রিকভারি ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। এর ফলে এলডব্লিউজি সনদও পাচ্ছে না এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো। আর স্পষ্টতই এর প্রাথমিক আঘাতটা লাগছে কাঁচা চামড়ার বাজারে, বিশেষ করে চামড়া সংগ্রহের মৌসুম বলে খ্যাত ঈদুল আজহার সময়ে। 

কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির পুরো টাকাটি যায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে, চামড়াশিল্পের নানামাত্রিক জটিলতার ফলে তারা যে বঞ্চিত হচ্ছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দশ বছর আগেও ঈদুল আজহার দিন সকাল থেকে এলাকায় ঘুরে ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করা গ্রাম-গঞ্জ,পাড়া-মহল্লার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে উৎসবের মতো ছিল। কখনো কখনো চামড়া সংগ্রহ করা নিয়ে এলাকা ভেদে সংঘর্ষে জড়ানোর মতো খবরও শোনা যেত। কালক্রমে সেসব এখন অতীত। নিকট ভবিষ্যতে চামড়াশিল্পের এ জটিলতা কাটবে কি না, এবং কাঁচা চামড়ার দাম বাড়বে কি না তা  মহল্লার চায়ের দোকানের আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর সবজান্তা ওই চাচাও বুঝতে পারছেন না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //