কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র

বন্যায় ভাসছে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও সিলেটের অসংখ্য গ্রাম। ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা গোমতী ও মুহুরী নদীর পানি প্লাবিত করে কুমিল্লা ও ফেনীর বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয় ফেনী জেলা। হাতেগোনা কিছু এলাকা বাদে পুরো জেলা বন্যার পানিতে ভেসেছে। তারপর কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম… বন্যা আক্রান্ত এলাকার তালিকা একে একে লম্বা হতে থাকে। বন্যাকবলিত মানুষের দুর্বিষহ পরিস্থিতির খবর পেয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে তাদের সাহায্যে ছুটে আসতে থাকে মানুষ।

পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করতে শত শত নৌকা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এগিয়ে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার স্বেচ্ছাসেবকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শিক্ষার্থীরা শুরু করে গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি। অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায় শহরজুড়ে। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ উজাড় করে অর্থ ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী দিতে থাকেন ত্রাণ তহবিলে। পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রাম-গঞ্জে ছাত্র, রাজনৈতিক দলের কর্মী, সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা রাস্তায় নেমে বন্যার্ত মানুষের ত্রাণ সহায়তার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে হাত পাতেন-এ দৃশ্য আবারও মনে করিয়ে দেয় প্রজাতন্ত্রের শক্তি জনগণ, কোনো সুশৃঙ্খল শক্তি নয়, মানুষের সাহায্যে সাধারণ মানুষই এগিয়ে আসেন এবং আসবেনও। মহাসড়কগুলোতে গেলে দেখা যায় হাজার হাজার ত্রাণবাহী গাড়ি ছুটে চলেছে বন্যাকবলিত এলাকায়। ছাদ খোলা সেসব গাড়িতে লাইফ জ্যাকেট শরীরে চাপিয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে শত শত মাইল পাড়ি দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের বড় অংশই ছাত্র কিংবা তরুণ। বৃষ্টি এলে ভিজছে, তীব্র রোদে পুড়ছে, রাতে কোথায় ঘুমানোর জায়গা মিলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই-তবুও এতটুকু হতাশা নেই চেহারায়! অন্যদিকে বন্যকবলিত এলাকায় পানি থেকে বাঁচতে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে মসজিদে-মন্দিরে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে! এমন ছবি, বর্ণনা ভেসে বেড়ায় সামাজিক মাধ্যমে।

এমন দৃশ্যের জন্যই নজরুল লিখেছিলেন-

“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’’

ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে একটু বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে, হয়তো তা থাকবেও। ঘুরেফিরে দু-এক গ্রামে অধিকাংশ ত্রাণ গেছে এমন খবরও পাওয়া যায়। আবার ত্রাণ দিতে গিয়ে ছবি তুলতে হুড়োহুড়ির অসংখ্য দৃশ্যও দেখা গেছে। নৌকা থেকে ত্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। এসব ছাপিয়ে পানিবন্দি মানুষ উদ্ধার করতে গিয়ে লক্ষ্মীপুরের তরুণ সাইফুল ইসলামের করুণ মৃত্যুর খবর সামনে এসে পড়ে। আত্মত্যাগের ইতিহাসটাই বড় নিশ্চয় সব থেকে। মারাত্মক বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষ অবস্থান নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, বাড়ি থেকে আনা গবাদিপশুর আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছে সেখানে। অনেকে বাড়ি ছেড়ে আসতে চাননি, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে শেষ মুহূর্তে বাধ্য হয়েছেন এমন মানুষও আছেন অসংখ্য। 

নিয়মিত খাবার সরবরাহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। এই স্বেচ্ছাসেবক দলের মধ্যে আছেন মেয়েরাও। ত্রাণ বিতরণ থেকে উদ্ধার কাজ সব ক্ষেত্রেই তারা অংশ নিয়েছেন। 

রাষ্ট্রীয়ভাবে বৃহৎ পরিসরে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালানোর আগে থেকেই সাধারণ মানুষ এগিয়ে গেছে বন্যায় ডুবতে থাকা মানুষের সাহায্যে। সেখানে ছাত্র থেকে পেশাজীবী যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন বিভিন্ন বিপরীত মতাদর্শের মানুষ। দল-মত নির্বিশেষে মানুষের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা শেষ কবে দেখা গিয়েছিল এ শতাব্দীতে? দেখা গেলেও তা এখনকার মতো এত মানুষকে কাছে টানতে পারেনি এ কথা তো বলাই যায়। একটি বন্যা ক্ষণিকের জন্য হলেও বদলে দিতে পারল, যদিও জল গড়িয়েছে বহুদূর, প্রাণও গেছে অনেক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //