রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘পুরাতনের হৃদয় টুটে, আপনি নূতন উঠবে ফুটে...’। পরিবর্তনে শুরু হয় নতুন দিনের। শিকল ভেঙ্গে মানুষ গেয়ে ওঠে জয়গান। বিশ্বের বিভিন্ন সময়ে এমন জয়গান গেয়ে মানুষ গড়েছে বিপ্লবের অমরকীর্তি।
রেনেসাঁ
রেনেসাঁ মূলত সাংস্কৃতিক জাগরণ। মধ্যযুগীয় অরাজকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল এই নবজাগরণ। চার্চের নির্দেশিত জীবনধারা ও গোঁড়ামি থেকে বের করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আঙিনায় উপস্থিত করেছিল মানুষকে। তাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি তথা মানব সভ্যতা অনেকগুণ এগিয়ে যায়।
রেনেসাঁসের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে মানুষ; সবকিছুর মানদণ্ড হয়ে ওঠে মানুষই। ইতালিতে শিল্প-সাহিত্য ও চিত্রকলায় যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল তা ইউরোপে-বিশেষ করে উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ইতালির রেনেসাঁস ধর্মকে বাদ দিয়ে গড়ে উঠলেও, ইউরোপের অন্যান্য দেশে ইরাসমাস, থমাস ম্যুর, রেবেলেয়াস প্রমুখ মানবতাবাদী ধর্মকে কেন্দ্র করেই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাদের লেখনী চূড়ান্ত পর্যায়ে মার্টিন লুথারের প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনকেই সহযোগিতা করেছে। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানব সমাজকে বহু দিক থেকে উন্নত করে তোলে। তাই আধুনিকতায় উত্তরণের ক্ষেত্রে নবজাগরণের অবদানকে সর্বদাই স্বীকার করে নিতে হয়।
ফরাসি বিপ্লব
পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসে ফরাসিতে পর পর তিনটি বিপ্লব ঘটে-ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), জুলাই বিপ্লব (১৮৩০) ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (১৮৪৮)। ফরাসি বিপ্লব দিয়ে এই তিন বিপ্লবের পরম্পরা শুরু হয়। এর মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতার ফ্রান্স রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করে।
প্রথম ফরাসি বিপ্লবে (১৭৯৮-১৭৯৯) ফ্রান্সের তৎকালীন বার্বোন রাজবংশের রাজা ১৬তম লুইসের পতন হয় এবং তার শিরচ্ছেদ করা হয়। এরপর নেপোলিয়ানের ক্ষমতায় আসা এবং জোট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর বার্বোন রাজবংশ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে।
দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লবে (১৮৩০) তৎকালীন রাজা ১০ম চার্লসের পতন হয় এবং রাজা লুইস ফিলিপ ক্ষমতায় আসে। তার নেতৃত্বে ফ্রান্সে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র কায়েম হয়। অবশেষে ১৮৪৮-এর বিপ্লবে রাজা লুইস ফিলিপের পতন হয় এবং ফরাসি রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি হয়।
ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বিভাজন চরম হয়ে ওঠে। বিপ্লবের নেতৃত্বে মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্যতা, ন্যায্যতা, সামরিক ও আর্থিক উন্নয়নের বিষয়ে নতুন ধারণা উদ্ভাবন হয়। এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেলে একটি গণতান্ত্রিক সরকার স্থাপন হয় এবং পূর্বের রাজপরিবারের শাসন শেষ হয়।
তবে অনেকে বলেন, ফরাসি বিপ্লব মূলত ব্যর্থ। এর কারণ, এই বিপ্লবে এমন অনেক জিনিস পুনঃস্থাপন হয় যা যে কোনো রাজত্বের পক্ষে ছিল ক্ষতিকর। এ ছাড়া সমাজের একটি বিশেষ পেশাদার এবং উঁচুশ্রেণির লোকদের ব্যাপক সুবিধা দেওয়া হচ্ছিল। শোনা যায় প্রচুর নারী নির্যাতনের কথা। আর এই বিপ্লবের পর বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য, যাজকশ্রেণির ভোগ-বিলাস চরমে ওঠে। অপরদিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে একটি জোয়ার সৃষ্টি হয়।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব
দৈনিক শ্রমের বদলে প্রযুক্তি বিদ্যার সাহায্যে অল্প সময়ে অল্প খরচে ব্যাপক পরিমাণের উৎপাদনকেই মূলত বলা হয় শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লব শিল্পের ক্ষেত্রে দ্রুত এবং আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইংল্যান্ডকে এটি ব্যাপক পরিবর্তনের পথে নিয়ে যায়।
শিল্প বিপ্লবের ফলে পরিবারকেন্দ্রিক, কুটিরশিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার অবসান ঘটে। গ্রামীণ বাসস্থানের বদলে উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে শহরের কারখানাগুলো। বেতনভোগী শ্রমিকরা যন্ত্রপাতির সাহায্যে উৎপাদন করতে থাকে। আগে পণ্যের মালিক ছিল এর উৎপাদক আর বিপ্লবের পর পণ্যের মালিক হয় কারখানার মালিক।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পরে দুটি সমস্যা দেখা দেয়। কাঁচামালের অভাব এবং উদ্বৃত্ত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য বাজার। সমাধানের একটিই মাত্র পথ ছিল, উপনিবেশ স্থাপন। যে কারণে সারাবিশ্বে ব্রিটিশ কলোনি গড়ে ওঠে। সমৃদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ইংল্যান্ডের সামাজিক ব্যবস্থায়ও বিপুল পরিবর্তন আসে। অর্থনীতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারায় মনোনিবেশ করেন। ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে স্থানীয় শিল্পের যাতে বিকাশ না-হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব তাদের জন্য যতটা মঙ্গলকর, তার কলোনির জন্য ততটাই অমঙ্গল। যার প্রমাণ আমাদের ভারতবর্ষ।
রুশ বিপ্লব
রুশ বিপ্লব ১৯১৭ সালে সংগঠিত দুটি বিপ্লবের মিলিত নাম। এর মাধ্যমে রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান হয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী মার্চ মাস) সংগঠিত প্রথম বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং শেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
কার্ল মার্কসের দর্শনে উদ্বুদ্ধ লেনিন এক শোষণহীন ও সামাজিক ন্যায্যতা ও সমতার জন্য সমাজ গঠনে এগিয়ে যায় এবং সমাজতন্ত্রের সকল নীতিকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে সবকিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানার অন্তর্ভুক্ত এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়া জারতন্ত্র থেকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। তিনি পরে নতুন শাসনতন্ত্র প্রদান করেন এবং বলশেভিক দলের নিজস্ব কর্মপন্থা ও দর্শন অনুযায়ী, সকল মানুষের মধ্যে সমতা স্থাপন, সকল জমি ও মূলধন রাষ্ট্রীয় করে মানুষের জীবনের উন্নতি সাধন করেন।
চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব
চীনা গৃহযুদ্ধ ও ১৯৪৯ সালের চীনা বিপ্লবে জেনারিলিসিমো চিয়াং কাই-শেকের কুওমিনতাং বাহিনীর বিরুদ্ধে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনা সমাজতান্ত্রিক দল জয়লাভ করে। পরাজিত চিয়াং কাই-শেক তাইওয়ানে পলায়ন করেন। এর ফলে ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও গণচীনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুংয়ের নের্তৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন শুরু হয় চীনে। তারপর ‘যেখানেই জনপদ, সেখানেই আইনি সেবা’ স্লোগান ধারণ করে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় চীনের বিচার বিভাগ। সমাজের সব মানুষের ঘরে ঘরে ন্যায়বিচার পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পথচলা শুরু হয় দেশটির বিচার বিভাগের। আজ ৭০ বছর পরও সেই লক্ষ্য সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশটির বিচারকেরা।
১৯৫৭ সালে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড মুভমেন্টের’ মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দিকে পা বাড়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। এ যাত্রায় মাধ্যম ছিল শিল্পায়ন ও সমবায়ীকরণ। এই সিদ্ধান্তের ফলেই চীনের আজকে এই অবস্থান বলে অনেকেই মনে করেন।
মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ সময় পুঁজিবাদী সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে মৃত্যু হয় চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুংয়ের। কমিউনিস্ট নেতা দেং জিয়াও পিং চীনের ক্ষমতায় বসেন। দেং জিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বেই বাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছিল চীন। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য চীনের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক সংস্কারও।
ইরানের ইসলামিক বিপ্লব
প্যারিস থেকে খোমেইনির তেহরানে পৌঁছানোর পর শাসক দলের পুরোপুরি পতন নিশ্চিত হয়। ফলে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান গঠিত হয়। নতুনভাবে রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু দেশের সর্বশক্তিমান হিসেবে ‘মহত্তম নেতা’ নামক নতুন পদ গঠন করা হয় এবং রুহুল্লাহ খোমেইনি ইরানের প্রথম মহত্তম নেতা ঘোষিত হয়। তার নেতৃত্বে ইরানে ধর্মতন্ত্র গঠিত হয়। শিয়া শরিয়ত আইন প্রবর্তিত হয়। সর্বোপরি বিপ্লবের ফলস্বরূপ ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ওলামাশ্রেণির হাতে আসেইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশে যুবকরা ইসলামি বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত হতে থাকে।
বিপ্লবের পর ইরানের লক্ষ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি বর্জনের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে ইসলামি শাসনের একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং যতটা পারা যায় সৌদির আধিপত্য ঠেকানো। যেটা ইরান সফলভাবে করতে পেরেছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh