কর্ণফুলী টানেলে আয়ের চেয়ে ব্যয় ৪ গুণ বেশি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উচ্চ খরচের প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কর্ণফুলী নদীর নিচে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। যা কর্ণফুলী টানেল নামে পরিচিত।

গত বছরের ২৮শে অক্টোবর এই টানেলটি উদ্বোধনের পর থেকে দৈনিক আয় ব্যয়ের যে হিসাব দিচ্ছে টানেল কর্তৃপক্ষ, তাতে দেখা যাচ্ছে আয়ের চেয়ে প্রতিদিন গড়ে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে। প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকারও বেশি।

প্রায় দশ হাজার সাতশো কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প কেন এত লোকসান গুনছে তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। এর কারণ খুঁজতে গতকাল শনিবার (২৬ অক্টোবর) সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শনে যান। ঋণের টাকায় নির্মিত হওয়ায় এই প্রকল্প থেকে থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয়ও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আগামী দিনগুলোতে এর ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

আজ রবিবার (২৭ অক্টোবর) সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগাযোগ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সঠিক সমীক্ষা ছাড়া একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল কর্ণফুলী টানেল। এখন কী করে এই লোকসান কমানো যায় আমরা সেটি পর্যালোচনা করছি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, মাটির তলদেশে নির্মিত যে কোনো প্রকল্পে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন খরচ অনেক অনেক বেড়ে যায়। সুতরাং এই প্রকল্প উত্তরণের আর উপায় আছে বলে আমি মনে করি না।

প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব কী?
সেতু কর্তৃপক্ষ গত ২২শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এক বছরের গাড়ি চলাচল ও আয় ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে বিবিসি বাংলাকে।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। যার মধ্যে মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি। বাসের পরিমাণ ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ শতাংশ। আর অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম।

টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে  ৩ হাজার ৯১০টি। এখন পর্যন্ত গত এক বছরে এই টানেল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেল থেকে টোল বাবদ আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকারও বেশি। অর্থাৎ আয়ের তুলনায় টানেলটি থেকে সরকারের লোকসান প্রায় চারগুণের কাছাকাছি।

টানেলটির ব্যবহার কেন কমছে?

২০২৩ সালে টানেল উদ্বোধনের পর ২০২৪ সালে গড়ে প্রতিদিন ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চলাচল করবে বলে সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল টানেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ২০২৪ এর অক্টোবরে এসে দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করছে ৩ হাজার ৯১০টি। যা প্রকাশিত সমীক্ষার চেয়ে চার ভাগের একভাগেরও কম।

কী কারণে টানেলটি ব্যবহার কমছে, বা সরকারের এত লোকসান গুনতে হচ্ছে? এমন প্রশ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেতু ও যোগাযোগ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, তখন এই প্রকল্পটিকে জাস্টিফাই করার জন্য একটা অবাস্তব ও প্রভাবিত সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছিল। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল ছিল না। এখন যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করছে সম্ভবত এটিই বাস্তব সংখ্যা।

তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা টানেল ব্যবহার কমার কিছু কারণের কথা বলছেন। তাদের মতে, কর্ণফুলী নদীতে এই টানেল নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলা। সেটি হয়নি নানা কারণে। এই টানেলে যানবাহন কিংবা আয় কমার পেছনে কয়েকটি টানেলে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের সুযোগ না থাকা, বাড়তি টোল ভাড়া ও কাছাকাছি দূরত্বে আরও একটি সেতু থাকার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

এখন কী করবে সরকার?

লোকসান কাটাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আমরা আসলে দেখছি কী করলে ট্রাফিক বাড়বে। সেটির জন্য নতুন করে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে তা আমরা দেখবো। তবে আমরা কোনো কাল্পনিক সংখ্যা দিয়ে সমীক্ষা করব না। কারণ আমাদের তো লোন পরিশোধ করতে হবে।

তবে, উদ্যোগ দিয়ে কি সংকট কাটানো যাবে? এমন প্রশ্নে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল হক মনে করেন, কিছু কিছু প্রকল্প থাকে মারাত্মক ভুল। সে সব প্রকল্প দিয়ে আসলে উত্তরণের কোনো উপায় থাকে না। কর্ণফুলী টানেল তেমন একটি। এই ভুলের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা ছাড়া সরকারের পক্ষ লোকসান কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ খোলা আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না।

যদিও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এই প্রকল্পটিকে তাদের বড় অর্জন হিসেবে প্রচার করে আসছিল। এখন লোকসান হলেও ঋণের টাকা পরিশোধে এটি চালু রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছেন না কেউই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh