অধ্যাপক আকমল হোসেন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ এএম
আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
মজলুম জননেতা হিসেবে খ্যাত মওলানা ভাসানী আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছে এক অজানা নাম। কারণ দেশ ও জনগণের জন্য তার যে অবদান, তা নিয়ে কোনো প্রচার নেই। বর্তমান যুগে ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানী ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিরোধী রাজনীতি শুরু হয়। অথচ পাকিস্তানে আসার আগে আসামে থাকার সময় মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে শুধু জড়িতই ছিল না, সংগঠনের রাজ্য সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন মওলানা ভাসানী।
যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার বিরোধিতা করার কাজটি সহজ ছিল না সে সময়। কিন্তু কেবল আওয়ামী লীগের রাজনীতির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখলেন না তিনি। পূর্ব বাঙলার স্বায়ত্তশাসন ও পাকিস্তানের মার্কিনঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের (কেন্দ্র ও পূর্বপাকিস্তানে ক্ষমতাসীন) সে সময়কার রক্ষণশীল অবস্থানের সঙ্গে তার দ্বিমত থাকায় তিনি নতুন রাজনৈতিক দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করলেন।
তবে তার পরিচয় শুধু আওয়ামী লীগ বা ন্যাপের মতো রাজনৈতিক দলের মধ্যে আটকে ছিল না। আসামে থাকার সময় বসতি স্থাপনকারী বাঙালি কৃষকদের তিনি নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার নেতৃত্বে বাঙালি কৃষকদের বিরুদ্ধে আসাম সরকারের ‘লাইন প্রথা’র বিরুদ্ধে কৃষক-জনগণ সংগঠিত হয়ে আন্দোলন করেছিল। কৃষক-শ্রমিকসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার কাজটি তিনি পাকিস্তানে এসেও অব্যাহত রাখেন। ‘মজলুম জননেতা’ অভিধাটি তার নামের অংশ হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটটি শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি থেকে তৈরি হয়েছিল।
বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলায় এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। পিতৃমাতৃহীন মওলানা ভাসানী লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, নিয়মিত খাওয়াপড়ারও সংস্থান ছিল না। একজন কিশোরের পক্ষে এত অভাবের মধ্যে দিন যাপনের মধ্য দিয়ে পরের জীবনের ‘মওলানা ভাসানী’ হয়ে ওঠা কি স্বাভাবিক ছিল?
কর্মজীবন শুরু হয়েছিল এক মক্তবের শিক্ষক হিসেবে। তিনি মক্তবের শিক্ষক হিসেবে নিতান্ত আটপৌরে সংসারী জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে আমৃত্যু এক সংগ্রামীর জীবন যাপন করে গেলেন। চাইলে কি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ভোগী জীবন বেছে নিতে পারতেন না? আসাম এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে তার মধ্যেই কাটিয়ে দিতে পারতেন তার সময়। কিন্তু বিরোধী হিসেবে যিনি জীবন শুরু করেন তার জন্য সে রকম জীবন কখনই কাম্য হতে পারে না। তিনি হয়ে উঠলেন ‘মজলুম জননেতা’, যার জীবন আক্ষরিক অর্থেই মজলুমের জীবন। পরনে যার খদ্দরের পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, মাথায় বাঁশের আঁশের তৈরি টুপি এবং পায়ে খুব সাধারণ চপ্পল। বাঁশ ও খড়ের তৈরি কুঁড়েঘর যার ঠিকানা ছিল চির জীবন।
মওলানা ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়টি গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুদ্ধ জোট ও তৃতীয় বিশ্বজুড়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতায়। পাকিস্তানের ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ সামরিক চুক্তিতে যোগদান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরকে মওলানা ভাসানী দেশ ও বিশ্বশান্তির অনুকূল মনে করেননি। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন এটা মওলানা ভাসানী প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলা আইন সভার সদস্য হিসেবে তার দেওয়া ভাষণে তীব্র ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা, ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে কেন্দ্রীয় সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া বিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার মধ্যে এর ইঙ্গিত ছিল।
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবিও উত্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় দেশের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থাকলেন। জীবন সায়ান্নে এসেও তার দেশপ্রেমের উপলব্ধিতে কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। তাই ভারত ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করলে পর দেশের ওপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবের কথা মাথায় এনে ফারাক্কা মিছিল সংঘটিত করলেন।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে কমিউনিস্টরা প্রধান শক্তি হিসেবে তার নেতৃত্ব মেনে কাজ করতেন। কিন্তু পাকিস্তান যুগের শেষ পর্যায়ে কমিউনিস্টরা সশস্ত্র লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। এরপর যে রাজনৈতিক শক্তি তার সঙ্গে ছিল, তারা তাকে সদুপদেশ দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। বরং তাকে আশ্রয় করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করার চেষ্টা করেছে। এখনো তার নাম ব্যবহার করে যে রাজনীতি বর্তমানে লক্ষণীয় তা তার জীবনাদর্শের সঙ্গে মেলে না।
দেশের রাজনীতিতে তার নাম এখনো উচ্চারিত হয় সংগত কারণে। তিনি ইতিহাসের অংশ হয়েছেন তার ত্যাগ ও নিবেদনের দ্বারা। তার সমসাময়িক রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে ক্ষমতা লাভের উপায় হিসেবে দেখেছিলেন। যে ক্ষমতা তারা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী রাজনীতিকে জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জনগণকে ক্ষমতাশালী করে তিনি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজটা করতে চেয়েছেন আজীবন। তার জনগণের ভেতর মধ্যবিত্ত যেমন ছিল, আরো বেশি করে শ্রমজীবী মানুষ ছিল। তাই তিনি শুধু নেতা ছিলেন না, মজলুম জননেতা ছিলেন।
বর্তমান বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানীর প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করা যায়। তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মধ্যে নেই, থাকতেও পারেন না। তবে তার রাজনৈতিক আদর্শের মৃত্যু নেই।
লেখক: সভাপতি, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh