সিন্ডিকেট! ১৫-১৬ বছর ধরে প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে ব্যবসা, সরকারি-বেসরকারি কাজ থেকে মিডিয়া-জগৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে রাজপথ, সব জায়গায় আমরা সবচেয়ে বেশি শুনেছি যে শব্দটি তা হলো এই সিন্ডিকেট।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অবৈধ মজুদদারি, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ঘুষবাণিজ্য, অস্ত্র ও মানব পাচার, নিজস্ব গ্রুপ তৈরি ও সদস্যদের অবৈধ সুবিধা প্রাপ্তি ইত্যাদি নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে সিন্ডিকেটগুলো। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখের সামনেই তারা তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়, কখনো কখনো সেগুলো হয় আরো নিষ্ঠুর ও শক্তিশালী। একদিকে যেখানে সাধারণ মানুষ এসব অপরাধের শিকার হয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার- এসব সিন্ডিকেটকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। কিন্তু কারা এই সিন্ডিকেট? কীভাবে গড়ে উঠছে এর চক্র? তাদের প্রভাবের পেছনের রহস্যটা কী? সিন্ডিকেট-মুক্ত দেশ কি আমরা আদৌ আশা করতে পারি?
সিন্ডিকেট কী, কীভাবে তৈরি হয়
সিন্ডিকেট শব্দটি সাধারণত একটি অপরাধী বা বাণিজ্যিক গোষ্ঠীকে বোঝায়, যা অপ্রকাশিত গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করে। যেখানে সদস্যরা সম্মিলিতভাবে লাভ বা সুবিধা অর্জনের জন্য নানা ধরনের বেআইনি কাজ করে থাকে।
সিন্ডিকেট গঠন প্রক্রিয়ার পেছনে থাকে অপরাধীচক্র, মাফিয়া এবং রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধীরা প্রথমে নানা ধরনের ছোটখাটো অপরাধের মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর অপরাধে হাত দেয়। কোনো সিন্ডিকেটের শিকড় একসময় সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে যায়, বিশেষ করে রাষ্ট্রের দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দেশের কিছু উন্নয়ন প্রকল্প, ব্যবসায়িক চুক্তি বা সরকারের বরাদ্দ থেকে তারা নিজেদের মুনাফা লাভের উপায় খুঁজে নেয়।
সিন্ডিকেটের বিস্তার
বাংলাদেশে ২০০০-এর দশকের পর থেকে সিন্ডিকেটের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি, রাজনৈতিক এমনকি বিনোদন জগতেও এসব সিন্ডিকেটের প্রভাব সুস্পষ্ট। কোথাও তা ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক আবার কোথাও এটি এক ভয়ংকর অপরাধীচক্রের আকার ধারণ করেছে।
ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট
বাংলাদেশে সবচেয়ে ব্যাপক ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। এখানে একাধিক ব্যবসায়ী, পরিবেশক বা সংস্থা একত্রিত হয়ে পণ্য বা সেবার দাম বাড়াতে বা কমাতে সহায়তা করে। মজুদদারি তাদের বিশেষ কৌশল, যেখানে পণ্য বা উপাদান বাজারে আনা হয় না, যার ফলে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, ওষুধ, ইলেকট্রনিক পণ্য, তেল-গ্যাস ইত্যাদির ক্ষেত্রে এসব সিন্ডিকেট কাজ করে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে পেঁয়াজ বা তেল সংকটের সময় সিন্ডিকেট-চক্র মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। এ সময় সাধারণ মানুষের ক্রয় করতে সমস্যা হলেও ব্যবসায়ীরা ঠিকই তাদের মুনাফার পাহাড় গড়তে থাকে। একইভাবে ডালের দাম, চালের দাম বা সবজির দামও কখনো কখনো সিন্ডিকেটের কারণে অস্থির হয়ে ওঠে।
দ্য নিউ এইজ বিডির তথ্য সূত্রে তিন বছরে নিত্যপণ্য জিনিসের দাম ৩৮ শতাংশ থেকে ২১৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে পুরো বিশ্বে যখন খাদ্যদ্রব্যের দাম কমে গিয়েছিল, তখনো বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম ১২.৫৪ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ!
এ ব্যাপারে ২০২৩ সালে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, পরিবহন ব্যয়, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। তবে একই বিষয়ে প্রশ্ন করলে কয়েকজন অর্থনীতিবিদ একবাক্যে ‘সিন্ডিকেট’কেই অভিযুক্ত করেছেন।
রাজনৈতিক সিন্ডিকেট
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট বেশ শক্তিশালী এবং এদের প্রভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে আছে। নির্বাচনের সময়, উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ, সরকারি সুবিধা অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে দেখা যায়। রাজনৈতিক সিন্ডিকেট সাধারণত সরকারি প্রকল্পের বরাদ্দ বা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।
এই সিন্ডিকেটগুলো সরকারের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে, তবে তারা সব দলের মধ্যেই ছড়িয়ে যেতে পারে। যার ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে। এ ধরনের সিন্ডিকেটগুলো সাধারণত তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে বা বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করে।
একটি দেশের রাজনৈতিক দল বা সরকারও একটি সিন্ডিকেট, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে জোট বেঁধে সমাজ ও অর্থনীতির বিবিধ অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্য পাঁচটি সিন্ডিকেটের মতোই একটি দেশের সরকার সুশাসন ও প্রজ্ঞাবলে জনগণের যেমন মঙ্গল আনতে পারে, একইভাবে অপকর্মের মাধ্যমে অথবা প্রজ্ঞার অভাবে তারা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করতে পারে।
একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে রাজনীতির অঙ্গনে সিন্ডিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা (যুদ্ধ ও সহাবস্থান) চলতে পারে। তাই স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় একটি (সিন্ডিকেটরূপী) সরকার বিদেশি শক্তির সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম।
অপরাধী সিন্ডিকেট
বাংলাদেশে অপরাধী সিন্ডিকেটের অন্যতম হচ্ছে মাদক ব্যবসা। মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটগুলো দেশব্যাপী এক বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এরা চোরাকারবারির মাধ্যমে বিদেশ থেকে মাদক এনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে। চাঁদাবাজি ও মানব পাচারের মতো অপরাধী সিন্ডিকেটও দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসব সিন্ডিকেট অবৈধভাবে ব্যবসা চালাতে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে বা অন্যায্যভাবে অর্থ আদায় করে। অনলাইনে প্রতারণা, বিনিয়োগে কোটিপতির স্বপ্ন, এটিএম কার্ড জালিয়াতি, জাল মুদ্রা, হুন্ডি, মুদ্রা পাচার ও সোনা চোরাচালান এমনকি ছিনতাইসহ যাবতীয় অপকর্মে জড়িত রয়েছে অপরাধীদের সিন্ডিকেট।
মিডিয়ায় সিন্ডিকেটের প্রভাব
সিন্ডিকেটের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে আমাদের সংগীত, টেলিভিশন-চলচ্চিত্র এমনকি সাংবাদিকতায়ও। বিনোদন জগতে সিন্ডিকেটের বাইরে থেকে কেউ এলে তার পক্ষে কাজ করা বেশ কঠিন, তা বিভিন্ন সময় তারকাদের অভিযোগেই উঠে এসেছে। এ ছাড়া মিডিয়া হাউসের নিয়োগ প্রক্রিয়াও অনেকটা সিন্ডিকেট-নির্ভর।
নতুন-পুরোনো যেকোনো হাউসে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের লোকজনই প্রাধান্য পায়। ফলে ভাষাগত দক্ষতা, সংবাদ নির্মাণসহ নানা যোগ্যতা থাকার পরও অনেক গণমাধ্যমে মেধাবীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না কিছু মিডিয়া-মুরব্বির কারণে। ফলে সাংবাদিকতা পেশাও হয়ে পড়ছে লবিং-নির্ভর।
রাষ্ট্র ও জনগণের সম্মিলিত লড়াই
সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকার নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রথমে দরকার ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী ও নির্দলীয় পদক্ষেপ। শুধু আইন প্রয়োগে নয়, সমাজের প্রতি সচেতনতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার মাধ্যমে এই অপরাধের শিকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh