পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৭ বছর: বাস্তবায়নে ‘নমনীয়’ ইউপিডিএফ

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি' সই করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। চুক্তি সইয়ের ২৭ বছর পার হলেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলা হচ্ছে।

২৭ বছরেও পাহাড়ে সংঘাত, হানাহানি আর রক্তক্ষরণ বন্ধে কার্যত উদ্যোগ না নেওয়ায় স্থায়ী শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। সবুজ পাহাড়ে হঠাৎ করেই ঝরছে রক্ত। তৈরি হচ্ছে নতুন, নতুন রাজনৈতিক ও জাতিভিত্তিক দলও। পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জেরে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা বেড়েছে।

তবে ২৬ বছর আগে পার্বত্য চুক্তির বিরোধী করে পাহাড়ের একমাত্র ও প্রথম আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি ভেঙে আত্মপ্রকাশ করা চুক্তির বিরোধীপক্ষ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সম্প্রতি চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলছে। দলটির মুখপাত্রের শর্ত, এর আগে জনসংহতি সমিতিকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করতে হবে।

এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর পূর্তির ক্রোড়পত্রে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ সরকারের সঙ্গে ছয়বার, পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সঙ্গে ১৩ বার এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সঙ্গে সাতবার অর্থাৎ পরপর তিনটি সরকারের সঙ্গে মোট ২৬ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ধারাবহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

শান্তিচুক্তির পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেন সন্তু লারমা। ছবি: সংগৃহীত 

এতে আরও বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ই আগস্ট ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আজ প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হলেও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ক্রোড়পত্রে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। কিন্তু ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জিত হয়নি। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জিত হয়েছে। এই চুক্তিকে বাস্তবায়িত না করার হীন উদ্দেশ্যে যে কোনো জুম্ম স্বার্থ বিরোধী অপতৎপরতা ও প্রচারণা, সর্বোপরি এই চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের যে কোনো চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। আমাদের পার্টি শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধীতা করে আসছে। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার যেমনি আন্তরিকতা দেখায়নি, তেমনি জনসংহতি সমিতিও (সন্তু লারমা) তেমন জোরালো কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি। কিন্তু পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি ও বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে আমরা পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন চাইছি। জনসংহতি সমিতি যদি জোরালোভাবে আন্দোলন করে তাহলে আমরা তাদের সঙ্গে আছি। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই জনসংহতি সমিতিকে আগে পাহাড়ের চলমান ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান জুপিটার চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের ২৭ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। তারপরও চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়নি। ফলে পাহাড়ে এখনো অশান্ত পরিবেশ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিগত সরকার ক্ষমতার মসনদে বসে ক্ষমতার স্বাদ নিতে প্রতিযোগিতা করেছে মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের রক্ষাকবচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৮টি ধারা আংশিক, ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। আমরা বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের কাছে চুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলোর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করছি। এছাড়া এ অন্তবর্তী সরকার যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন কমিশনকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। এ কমিশনের কাছে আমরা দাবি করছি, সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলে যে সমস্ত আদিবাসী জাতিসমূহ রয়েছেন তাদের প্রত্যক জাতিসমূহের নাম যাতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে জাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। আমরা আশা করছি বর্তমান অন্তবর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য বিগত সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন না।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে হয়েছে। আমরা মনে করি, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু দেশকে নতুন সাজাচ্ছে, সংস্কার করছে তারা অবশ্যই চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবেন। দেশের প্রতিটা নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh