নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ পিএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘গুমের’ শিকার হয়ে যে ‘ট্রমা’ তৈরি হয়েছিল, তাতে দুইবার 'আত্মহত্যা' করার কথাও ভেবেছিলেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে দুইবার তিনি 'আত্মহত্যা' করার কথাও ভেবেছেন। সেই ‘ট্রমা’ থেকে বেরিয়ে আসতে চিকিৎসকের পরামর্শও তাকে নিতে হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ অডিটরিয়ামে বুধবার 'সকল প্রাণের নিরাপত্তা’ (সপ্রাণ) নামের একটি সংগঠন 'গণহত্যা, গুম ও ভয়ের সংস্কৃতি- মানবিক মর্যাদা ও সুবিচারের দাবি' শিরোনামে আলোচনা সভায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন ফরহাদ মজহার। এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
ফরহাদ মজহার বলেন, যারা গুম হয়েছেন, তারা কি ফিরে আসবেন? তারা কোথায় আছেন? এটা থেকে যে ট্রমা তৈরি হয়, তা ভয়াবহ। এই ট্রমায় কেবল গুম হওয়া ব্যক্তি নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝেও ট্রমা তৈরি হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সকালে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। বিষয়টি নিয়ে সব মহলে আলোচনার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা পর গভীর রাতে যশোরে বাস থেকে তাকে উদ্ধারের নাটকীয় বিবরণ দেয় র্যাব।
ফরহাদ মজহারের পরিবার সে সময় অপহরণের অভিযোগ করেছিলেন থানায়। সরকারের কোনো সংস্থাই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ‘উদ্ধারের নাটক’ সাজিয়েছে বলে জোর সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেকে।
তবে শেষ পর্যন্ত অপহরণের অভিযোগটি ‘ভুয়া’ আখ্যা দিয়ে সেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ। উল্টো ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধেই ‘নিজের অপহরণের নাটক সাজানোর’ অভিযোগ তুলেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
নিজেদের সিদ্ধান্তের পক্ষে এক নারীকেও সে সময় আদালতে হাজির করেছিল পুলিশ। নিজেকে ফরহাদ মজহারের শিষ্য দাবি করে এই নারী জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সেদিন ফরহাদ মজহার তার জন্য অর্থ জোগাড় করতেই বেরিয়েছিলেন এবং ১৫ হাজার টাকাও পাঠিয়েছিলেন।
বুধবারের অনুষ্ঠানে দেওয়া দীর্ঘ বক্তৃতায় ফরহাদ মজহার বলেন, কারো পরিবারে যদি এভাবে কেউ গুম না হয়ে থাকে, তাহলে এটা বোঝা ভীষণ রকম কঠিন। আমি নিজেও গুম হয়েছিলাম। এটা টলারেট করা যে কত কঠিন, তা বুঝেছি।
"আমি দুইবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। আমি ডাক্তারের কাছে যখন গিয়েছি, ডাক্তার আমাকে বলেছেন, 'এটা তুমি ভুলে যাও, ভাবো এই ঘটনাটি ঘটেনি'। আমি তখন গুমের পেইনটা বুঝেছি। আপনি যখন জানবেন, আপনাকে বা আপনার পরিবারের কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। অথবা ভয়াবহ নির্যাতন করা হবে। তার অনুভূতিটা ভয়ঙ্কর। আপনার ভাইকে আপনার সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তা যে ট্রমা তৈরি করে- এটা ভয়ঙ্কর।"
রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন থাকার পরও গুম কেন হয়? রাষ্ট্র কেন এটা করে? সেজন্য রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ফরহাদ মজহার, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে উবিনীগ নামে একটি এনজিও গড়ে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেন।
সংবিধান বাতিল করে রাষ্ট্র গঠনের তাগিদ দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, "সংবিধান অনেক আইনের মধ্য দিয়ে নাগরিকের উপর নিপীড়ন করে।"
নাগরিকরা ‘মানবিক মর্যাদা চায়, সত্য জানতে চায়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানবিক মর্যাদা কথায় কথায় বুঝলে হবে না, সমাজে এর প্রয়োগ থাকতে হবে। সত্য জানার অধিকার আমাদের আছে। যারা গুম হয়েছে, তারা কি বেঁচে আছে? তাদের কেন নেওয়া হয়েছে? এর উত্তর অন্তর্বর্তী সরকারকে জানাতে হবে। যে প্রশ্নের সমাধান করা জরুরি, তা আমরা করছি না।
ইতিহাসকে 'থিয়েট্রিকালি রিপিট করে’ দেখাতে হয় মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন, নইলে ইতিহাস ভুলে যায় মানুষ।
মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না– এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্নের কথাও শোনান এই চিন্তক।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র যখন দুর্বল হয়, তখন সে প্রতিপক্ষকে দমন করার পদ্ধতি হিসেবে এ ধরনের গুম-খুনের পথে হাঁটে।
দেশের পুলিশ ব্যবস্থাকে একটি ‘ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা’ হিসেবে বর্ণনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, পুলিশ মনে করে যে সরকারে থাকবে, তার সেবা করাটাই কাজ। রাষ্ট্র এবং সরকার যে আলাদা। এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করি না।
বিগত সরকারের সংবিধান এবং শাসন কাঠামো থেকে না বেরিয়ে আসতে পারলে ‘করুণ পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
ফরহাদ মজহার বলেন, এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পরও আমরা রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ব্যবহার করছি। আমরা এখনো ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনেই আছি। পুরনো আইনেই তো চলছি।
ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না, এমন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখার কথাও বলে তিনি।
মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান লিটন অনুষ্ঠানে বলেন, ৫ অগাস্টের আগে আমরা জানতাম না কোনো নারী গুমের শিকার হয়েছেন। ২০১৫ সালে একজন নারী গুমের শিকার হয়েছেন। তার সন্তান থেকে মাকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই নারীর খোঁজ আমরা এখনো জানি না।
স্বামী বা পরিবারের সদস্যের গুমের কারণে ওই পরিবারের নারী সদস্যদের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে বক্তব্য দেন ইয়াসমিন আরা।
তিনি বলেন, গুম যারা হয়েছেন, তাদের স্ত্রী বা স্বজনদের লড়াইয়ের জায়গাটা আমরা খুব কমই দেখি। একজন নারীর সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি বিয়ের আগে ঢাকা শহরের কিছুই চিনতেন না। কিন্তু তার স্বামীকে খুঁজতে পুরো ঢাকার অলিগলিতে ঘুরেছেন। এই নারীদের কথা উঠে আসে না। অনেক নারী, যারা গৃহিনী, কোনোদিন বাড়ির বাইরে যেতে হয়নি। তার সামনে স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সেই নারীকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
গুমের শিকারদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'মায়ের ডাক' এর সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি, জুলাই আন্দোলনে শহীদ ফারহান ফাইয়াজের পরিবারের সদস্যরাও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : আত্মহত্যা ফরহাদ মজহার ট্রমা গুম
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh